সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, এমন এক জায়গা যেখানে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্ট, ছবি বা গল্প আমাদের মনের মধ্যে এমন ভাবনা তৈরি করে, ‘হয়তো আমারও ওখানে থাকার কথা ছিল’, ‘ওর মতো কাজ করা উচিত ছিল’, বা ‘ওর মতো সঙ্গী হলে জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতো।’ এই তুলনা ও অস্বস্তি থেকে অনেকেই নিজেদের জীবনে সন্তুষ্টি খুঁজে পান না।
বরং অজান্তেই অন্যদের সুখে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেন, যা তাদের নিজেদের বর্তমান অবস্থায় সুখী হতে বাধা দেয়। এর ফলে এক মিথ্যা মোহে বন্দি হয়ে বারবার হতাশা ও অসুখী জীবনের দুষ্টচক্রে পড়ে যান।
আরও পড়ুন: ফেসবুক মনিটাইজেশন-এ আসছে পরিবর্তন: আয় আরও বাড়বে
ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহারে কীভাবে সময়ের অপচয় হচ্ছে?
আমরা প্রায়শই কোনো বিষয় সার্চ করতে গিয়ে বা নতুন কিছু দেখতে ফেসবুকে ঢুঁ মেরে থাকি। একবার ফেসবুকে ঢুকলেই সেই নিরীহ উদ্দেশ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেটে যায় ৩০ মিনিট, কখনও আরও বেশি। কিন্তু যখন নিজের অজান্তেই এতটা সময় চলে যায়, তখন আমরা বুঝতে পারি যে সেই সময়টুকু আসলে খুবই অপচয় হয়ে গেছে। এভাবে, জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকেন।
ফেসবুক ও মানসিক স্বাস্থ্য: ক্ষতির গভীরতা
ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহারে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বা এটেনশন স্প্যান দিন দিন কমছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে উদ্বেগ, হতাশা, এবং ঘুমের সমস্যার মতো মানসিক সমস্যা। এমনকি অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে স্থূলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং হৃদরোগের মতো শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের ডিজিটাল আসক্তির ফল হিসেবে দেখা দিচ্ছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ফ্রড, এবং অন্য ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রবণতা, যা এখন প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের বাস্তব চিত্র।
আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপ নতুন যুগে নতুন ফিচার: ফোন নম্বর ছাড়াই মেসেজিং!
কিশোর-কিশোরীদের ওপর ফেসবুকের প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারে কিশোর-কিশোরীদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের ২০২১ সালের ইয়ুথ রিস্ক সার্ভে থেকে পাওয়া কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো:
- (১) যারা দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটায়, এমন কিশোর-কিশোরীদের বিষণ্নতা এবং দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ।
- (২) ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ তাদের শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে, এবং ৬৪ শতাংশ মাঝেমধ্যে বা প্রায়শই ঘৃণাভিত্তিক কন্টেন্টের সম্মুখীন হয়।
- (৩) ৫০ শতাংশ টিনএজার মনে করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বের হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, এক বছর ধরে তাদের মধ্যে খারাপ লাগার অনুভূতি কাজ করছে। এমনকি, ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী গভীরভাবে আত্মহত্যার কথা ভেবে দেখেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিরতি: কী উপকার পাওয়া যায়?
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বাথের গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিরতি নিলে প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত ৯ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এটি আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও, এটি মানুষকে তাদের মনোযোগ বেশি কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
আরও পড়ুন: 2024 সালের ফ্রি টাকা ইনকাম করার সেরা Apps ও ওয়েবসাইট
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: সময় ও এনার্জির অপচয়ের প্রধান কারণ
গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের সময় এবং এনার্জি তিনটি প্রধান জায়গায় বেশি অপচয় হয়—প্রথমত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দ্বিতীয়ত অযথা দুশ্চিন্তা, এবং তৃতীয়ত অর্থহীন সম্পর্ক। এই তিনটি কারণ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, যা আমাদের জীবনের স্থিতি এবং সুখের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযম ও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। জীবনের প্রকৃত সুখ এবং মানসিক শান্তির জন্য বাস্তব জীবনের সঙ্গেই বেশি সময় কাটানো উচিত।
ফেসবুক ব্যবহারে কিছু প্রস্তাবিত নির্দেশনা
ফেসবুক ব্যবহারের এই নেতিবাচক প্রভাবগুলো কাটিয়ে উঠতে, আমাদের প্রয়োজন কিছু সঠিক নির্দেশনা এবং সচেতনতা। এখানে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে, যা ফেসবুকের অপব্যবহার রোধে এবং ব্যক্তিগত জীবনে সুখ ধরে রাখতে সহায়ক হতে পারে:
- নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ: প্রতিদিন ফেসবুকে কাটানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন। অতিরিক্ত সময় ফেসবুকে ব্যয় না করে নিজের কাজ এবং জীবনের প্রতি মনোযোগ দিন।
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রেক নিন: একটানা ফেসবুক ব্যবহারের বদলে কিছু দিন বিরতি নিন। এর ফলে নিজের জীবনের প্রতি মনোযোগ বাড়বে এবং মানসিক শান্তি ফিরে আসবে।
- নিজের সাথে অন্যের তুলনা বন্ধ করুন: ফেসবুকে অন্যের জীবনের সাফল্য দেখেও নিজের জীবনের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করুন। নিজেদের জীবনকে অন্যদের সাথে তুলনা না করার চেষ্টা করলে মানসিক শান্তি বজায় থাকে।
- দৈনন্দিন জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার গুরুত্ব দিন: ফেসবুকের বাইরের পৃথিবীকে অনুভব করতে শখের কাজে মনোযোগ দিন, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করুন, পরিবারের সাথে সময় কাটান।
- নেতিবাচক কনটেন্ট এড়িয়ে চলুন: যারা নেতিবাচক বা ঘৃণামূলক কনটেন্ট পোস্ট করেন, তাদের ফলো করা কমিয়ে দিন এবং নিজের টাইমলাইনে শুধুমাত্র ইতিবাচক পোস্ট বা কনটেন্ট রাখুন।
উপসংহার
ফেসবুক আমাদের জীবনে ইতিবাচক সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরি করলেও অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। নিজেকে ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে, সময় নিয়ন্ত্রণ, সঠিক কনটেন্ট নির্বাচন এবং নিজের জীবনের প্রতি মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
1 thought on “ফেসবুক কীভাবে আপনাকে অসুখী মানুষে পরিণত করছে, আপনি জানেন?”