বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এখন এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আদালতে বিচারপ্রার্থীরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন, তার একটা বড় অংশ যাচ্ছে দালাল ও পেশকারদের পকেটে। এমনকি এর পরিমান আইনজীবী-র চেয়ে বেশি দিতে হয়। এই পরিস্থিতি শুধু একজন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র বিচার ব্যবস্থার জন্যই অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আরও পড়ুন: Cheque সম্পর্কে ৯৯% মানুষই জানে না, যে নিয়ম না জানলে হতে পারে বিপদ
ঢাকার আদালতগুলোতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ বিচার প্রার্থনা করতে আসেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলামটরের হাজেরা খাতুনের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি তার ছেলের জামিনের জন্য আইনজীবীকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এর পরেও তাকে পেশকার ও পুলিশের কাছে আরও ২,৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। এমনকি জামিন পাওয়ার পরেও তাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। এই ধরনের খরচ বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না এই পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, অনেক আইনজীবী নিজেদের ফি বাড়ানোর জন্য বিচারপ্রার্থীদের এমন ধারণা দেন যে, বিচারকদের উপঢৌকন বা আর্থিক সুবিধা দিতে হয়। তিনি স্বীকার করেছেন যে আদালতে দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে এবং কিছু বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগও রয়েছে।
অধস্তন আদালতগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ
অনেকে আদালতে এসে দালাল ও পুলিশের খপ্পরে পড়েন। কয়েকজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন যে, পুলিশ বা দালালকে দুই-তিনশ টাকা দিলেই গারদখানায় কয়েদির সাথে দেখা করা যায়। সিগারেট বা খাবার পাঠানোর জন্যও ৫০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়।
আরও পড়ুন: কত বছর একই বাড়িতে থাকলে ভাড়াটিয়া মালিক হতে পারে? অনেকেই জানে না
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মাঈন উদ্দিন চৌধুরী এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে বলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া গারদখানায় আসামির সাথে কাউকে দেখা করার সুযোগ না দিতে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গারদখানার সীমানায় খাবারের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকায় ১৫টি বিষয়ভিত্তিক আদালতে প্রায় দেড়শ বিচারক রয়েছেন। এসব আদালতে দেওয়ানি, ফৌজদারিসহ বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার হয়। কিন্তু সরকারি ফি’র বাইরে জামিননামা দাখিল, রায়ের সার্টিফায়েড কপি তোলাসহ বিভিন্ন কাজে বকশিশ বাণিজ্যের জোর অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতি শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সব আদালতেই প্রায় একই রকম।
দুর্নীতির বিভিন্ন রূপ
বিচারপ্রার্থী ও বিচার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আদালতে অন্তত আটটি ক্ষেত্রে বকশিশ দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
১. মামলা ফাইল করতে পেশকারকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
২. জামিন দরখাস্ত জমা দিতে পিয়নকে ১০০ ও পেশকারকে ২০০ টাকা।
৩. জামিননামা দাখিলে জিআরওকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
৪. পক্ষভুক্ত দরখাস্ত দিতে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা।
৫. নিষেধাজ্ঞা দরখাস্ত দিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
৬. মামলার তারিখ পছন্দমতো নিতে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।
৭. খসড়া নকল তুলতে জিআরওকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
৮. সহিমুহুরি নকল নিতে নকলনবিশকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
এছাড়াও হাজিরার জন্য পুলিশকে জনপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়। মামলার শুনানির তারিখ পড়ার পর এক আদালত থেকে অন্য আদালতে নথি আনতেও পুলিশ বা পিয়নকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়।
আরও পড়ুন: এক্স মানে কি গুগল? না জানলে জেনে নিন এর বিভিন্ন অর্থ ও ব্যবহার
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা বিচারপ্রার্থী রওশন আরা এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, “কোর্টে মামলার বিচার শেষ হয় না। বারবার তারিখ পড়ে আর টাকা পায় উকিল-মুহুরি। সমন জারি করতেও টাকা দিতে হয়। এগুলো কেউ দেখে না।”
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম স্বীকার করেছেন যে, অতীতের ধারাবাহিকতায় ঢাকার আদালতে দুর্নীতি-অনিয়ম চলছে। তিনি বলেন, “পেশকার, সেরেস্তাদার, জিআরও, পুলিশ কারও আচরণ পরিবর্তন হয়নি।”
উচ্চ আদালতেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়
মামলার কপি, আদেশের কপি তোলাসহ নানা ধাপে টাকা দিতে হয়। এই লেনদেনে জড়িত আইনজীবীর সহকারীরা। সুপ্রিম কোর্টে সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় মামলার সিরিয়াল নির্ধারণে। সিসিটিভি স্থাপনসহ প্রশাসনের নানা তদারকির পরও এই লেনদেন বন্ধ হয়নি।
আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন শাখায় মামলার ধরন অনুযায়ী ২০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বকশিশ দিতে হয়। শুনানির জন্য মামলার তারিখ এগিয়ে নিতে বকশিশ দিতে হয় ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা।
উচ্চ আদালতে প্রতারকের খপ্পরে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী গত বছর জানিয়েছিলেন যে, তাঁর এক স্বজন আদালত প্রাঙ্গণে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে ১৯ লাখ টাকা হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ লাখ টাকা একজন আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছিল, যার পরে কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। রায়ের নকল তুলতে আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও পাওয়া যায়নি।
বর্তমান প্রধান বিচারপতিও স্বীকার করেছেন যে, উচ্চ আদালতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, “অনেক সময় সুপ্রিম কোর্টের এফিডেভিট শাখা, ডেসপাচ শাখা ও নকল শাখা সম্পর্কে নেতিবাচক খবর কানে আসে।”
অভিযোগ রয়েছে বিচারকদের বিরুদ্ধেও
২০১৯ সালে দুর্নীতি ও গুরুতর পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগে তিন বিচারপতিকে বিচারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের অক্টোবরে নানা অভিযোগে হাইকোর্টের আরও ১২ বিচারপতিকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৫০ জন বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখনও প্রায় ২০ জন বিচারকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনেও অর্ধশত বিচারক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চলছে।
বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট। গত সরকারের আমলে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমাদের জনগণও দুর্নীতিপ্রবণ।’ তাঁর মতে, বিচারক-আইনজীবী বাদ রেখে একটি স্বাধীন জুডিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গঠন করা দরকার। এই প্রতিষ্ঠান সব আদালতের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে এবং তা প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করবে। তাহলে কিছুটা হলেও দুর্নীতি রোধ সম্ভব হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা অনেকটা সতর্ক হয়ে গেছে, তারা আতঙ্কগ্রস্ত। আশা করছি, বিচার বিভাগে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’