ঢাকা বিনোদন ডেস্ক: “ভুলে যেতে চাই আমি মৌসুমী ছিলাম”: শেষ নাকি এক নতুন শুরু?
বাংলা সিনেমার প্রিয়দর্শিনী, কিংবদন্তি অভিনেত্রী মৌসুমী—যার অভিনয় জীবনের সঙ্গে মিশে আছে কোটি ভক্তের আবেগ, স্মৃতি আর ভালোবাসা। তারই মুখে উঠে এসেছে এক বেদনাবিধুর স্বীকারোক্তি—“সানি, আমি ভুলে যেতে চাই আমি মৌসুমী ছিলাম।”
এই একটি বাক্য যেন কাঁপিয়ে দিয়েছে তার ভক্তদের হৃদয়। এটা শুধু কোনো তারকার অভিনয়জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, এটা যেন এক যুগের শেষ কথা।
আরো পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম বিকাশে পেমেন্ট – কোনো ইনভেস্ট ছাড়াই ঘরে বসে আয় শুরু করুন!
সেই মেয়েটি, যে একদিন ছিল ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর মিষ্টি মুখ
মাত্র ২০ বছর বয়সে বাংলা চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন মৌসুমী। সালমান শাহর বিপরীতে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় তার অভিষেক ছিল যেন ধূমকেতুর মতো। দর্শকরা পেয়েছিল নতুন এক রোমান্টিক আইকন, যার অভিনয়, হাসি আর কণ্ঠস্বর মানুষকে বুঁদ করে রেখেছিল দিনের পর দিন।
তারপর সময় গড়িয়েছে। ‘প্রিয় তুমি’, ‘সুখের স্বর্গ’, ‘দেনমোহর’, ‘আত্ম-অহংকার’—প্রতিটি সিনেমায় নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। ৯০-এর দশকে কেউ যদি ঢাকাই সিনেমার আসল তারকার কথা বলেন, সেই তালিকায় সবার ওপরে থাকবে মৌসুমীর নাম।
জীবনের বাঁকবদল: যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি
২০২৩ সালের অক্টোবর। মৌসুমী চুপিচুপি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। সঙ্গে তার মেয়ে ফাইজা এবং অসুস্থ মা। প্রাথমিকভাবে সবাই ভেবেছিল, কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ফিরবেন। কিন্তু সময় বাড়তেই থাকে, ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে।
তার স্বামী, অভিনেতা ওমর সানী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মৌসুমী এখনই ফিরছেন না। মেয়ের পড়াশোনা আর শাশুড়ির অসুস্থতার কারণে ওর এখন পরিবারকেই সময় দেওয়া জরুরি।”
এই বক্তব্যে যতটা না বাস্তবতা, তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার ছোঁয়া লুকিয়ে আছে। কারণ তার ঠিক পরেই আসে সেই বাক্য—“সানি, আমি ভুলে যেতে চাই আমি মৌসুমী ছিলাম।”
আরও পড়ুন
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা


তারার ম্লান আলো: এক অভিমান, এক অবহেলা
এক সময়ের দাপুটে নায়িকা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী আজ নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইছেন। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও যেন লুকিয়ে আছে ওমর সানীর কণ্ঠে—“তার মত একটা লিজেন্ড নিয়ে ভালো কাজ তৈরি করবে এমন ভাবনা তো কারো নেই।”
নতুন প্রজন্মের সৌজন্যবোধ নিয়েও কষ্ট প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, “নতুনরা ভাবে, তারা আজ মৌসুমীর চেয়েও বড় তারকা হয়ে গেছেন। ওদের ভেতর সেই সম্মানবোধটা নেই।”
প্রশ্ন জাগে, শিল্পী যদি নিজ ঘরেই অবহেলার শিকার হন, তবে কি তিনি অভিনয়ে ফেরার কথা ভাববেন? হয়তো না। মৌসুমীও তাই করেছেন। তিনি বেছে নিয়েছেন নীরবতা, দূরত্ব, পরিবারকে ঘিরে নতুন এক পৃথিবী।
তবে কি সবই শেষ?
একসময় যারা বলতেন, ‘বাংলা সিনেমা মানেই মৌসুমী’, আজ তারাই স্তব্ধ। কারণ এই খবর শুধু একটি অভিনয়জীবনের অবসান নয়, এটি এক আবেগঘন অধ্যায়ের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
তবে এখানেই কি শেষ?
না, এখনও শেষ নয়।
গত ২৭ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ডে প্যারেড অ্যান্ড ফেস্টিভ্যাল’-এর মঞ্চে গান গেয়েছেন এই অভিনেত্রী। সেটা প্রমাণ করে, তার ভেতরের শিল্পী এখনো জীবিত, সক্রিয়, আবেগপ্রবণ। অভিনয় নয়তো কী, শিল্প তো তার প্রকাশের মাধ্যম।
আরো পড়ুন: অনলাইন ইনকাম এবার হবেই: রইলো ১০ উপায়, লাগবেনা অভিজ্ঞতা
একত্রিত জীবনের গল্প: সানী-মৌসুমী
১৯৯৫ সালের ২ আগস্ট, তারা পরস্পরের ভালোবাসার শপথ নিয়ে জীবন শুরু করেন। একসঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘দোলা’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘প্রিয় তুমি’, ‘হারানো প্রেম’ সহ বহু সিনেমায়।
তাদের জুটি ছিল বাস্তব ও রূপালী পর্দা—দুই জায়গাতেই আদর্শ এক ভালোবাসার প্রতীক। আজও সেই বন্ধন অটুট। সানী যখন বলেন, “ক্যামেরা থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততটাই ভালো,” তখন বোঝা যায়, এই দুই শিল্পী জীবনের ভিন্ন প্রান্তে এসে পা ফেলেছেন।
সামাজিক মাধ্যমে ভক্তদের প্রতিক্রিয়া
খবরে মৌসুমীর সরে যাওয়ার খবর প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যম প্লাবিত হয়ে যায় আবেগে। কেউ লিখেছেন, “আপু, আপনি আমাদের শৈশবের নায়িকা, আপনি হারিয়ে যেতে পারেন না।”
আরেকজন মন্তব্য করেন, “এই দেশে যদি সম্মান পেতেন, তাহলে হয়তো এই কথা বলতেন না—‘ভুলে যেতে চাই আমি মৌসুমী ছিলাম।’”
অনেকেই তার জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর দৃশ্য শেয়ার করে ‘ফিরে আসার অনুরোধ’ জানাচ্ছেন। টিকটকে দেখা যাচ্ছে মৌসুমীর সিনেমার সংলাপ ও গান নিয়ে আবেগময় ভিডিও, ফেসবুকে স্ট্যাটাসে কষ্টের ছোঁয়া—সব মিলিয়ে স্পষ্ট, তিনি আজও হৃদয়ে বাস করেন।


জনপ্রিয় সিনেমা ও ডায়লগ: যা আজও জীবন্ত
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’–এর সেই বিখ্যাত সংলাপ, “ভালোবাসা কি অপরাধ?” কিংবা ‘সুখের স্বর্গ’–এর করুণ মুখভঙ্গি—এগুলো শুধু ডায়লগ নয়, মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।
মৌসুমীর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার চোখের ভাষা। একটি সংলাপ না বলেও অনেক কিছু বলে দিতে পারতেন তিনি।
আরও পড়ুন: ফেসবুক স্টোরি থেকে আয়ের সুযোগ: কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুখবর, পারবনে আপনিও
নারীদের অনুপ্রেরণায় মৌসুমী
বাংলাদেশি নারীদের কাছে মৌসুমী ছিলেন এক অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন সেই নারীকণ্ঠ, যিনি নিজের শক্তি, সম্ভাবনা ও স্বতন্ত্রতা দিয়ে এককভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
আজও তরুণীরা তাকে অনুসরণ করেন তার স্টাইল, আত্মবিশ্বাস, পারিবারিক মূল্যবোধ ও পেশাগত সাফল্যের জন্য।
পরিচালনা ও প্রযোজনায় যাত্রা
শুধু অভিনয়েই নয়, মৌসুমী পা রেখেছেন পরিচালনা ও প্রযোজনায়ও। ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ সিনেমা দিয়ে তার পরিচালনায় অভিষেক। সে সিনেমাও পেয়েছিল সমালোচকদের প্রশংসা।
পরবর্তীতে তিনি আরও কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ও নাটকের কাজ করেন। তার প্রযোজনায় ছিল মানসম্পন্ন গল্প ও সমাজ সচেতনতামূলক বার্তা।
জীবনের নতুন অধ্যায়
অভিনয়, গান, পরিচালনা, প্রযোজনা—সবই করেছেন মৌসুমী। আজ তিনি অভিনয় না করলেও, তার কর্ম, তার স্মৃতি, তার হাসি, তার চোখের ভাষা—সবকিছু চিরকাল রয়ে যাবে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে।
ভবিষ্যতে তিনি ফিরবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে যদি ফিরে না-ও আসেন, তবুও তার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কারণ মৌসুমী কোনো নাম নয়, কোনো পেশা নয়, মৌসুমী একটি আবেগ, একটি অনুভব, একটি প্রজন্মের সিনেমা-ভালোবাসার প্রতীক।
আমরা শুধু এটাই চাই, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন প্রিয়দর্শিনী। ভুলে যান না আপনি ‘মৌসুমী’ ছিলেন না, আপনি এখনো আছেন—হাজারো হৃদয়ে, অগণিত আলোয়।