ঈদ স্পেশাল ট্রেন: ঈদুল ফিতর মানেই ঘরে ফেরা। পরিবারের সঙ্গে খুশির ভাগাভাগি, গ্রামের বাড়ির স্নিগ্ধ পরিবেশে একটু প্রশান্তির আশ্রয় নেওয়ার আনন্দ। এই আনন্দযাত্রার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন হচ্ছে রেলপথ, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য। কিন্তু বারবার বঞ্চনার শিকার হয়ে এ আনন্দ যাত্রা পরিণত হচ্ছে এক দীর্ঘশ্বাসে—রংপুরবাসীর জন্য।
বলতে পারেন এই বৈষম্যের শেষ কোথায়?
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
২০টি বিশেষ ট্রেন, রংপুরের ভাগ্যে একটিও নয়
বাংলাদেশ রেলওয়ে এবার ঈদ উপলক্ষে ঘোষণা দিয়েছে ১০ জোড়া অর্থাৎ ২০টি বিশেষ ট্রেন চলবে দেশের বিভিন্ন রুটে। উদ্দেশ্য একটাই—ঈদযাত্রায় বাড়তি যাত্রী চাপ সামাল দেওয়া এবং মানুষকে নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এই ২০টি ট্রেনের একটিও আসেনি রংপুরের ভাগ্যে।
রেল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ঢাকার সঙ্গে দেওয়ানগঞ্জ, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ, জয়দেবপুর-পার্বতীপুর, ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর, পার্বতীপুর-দিনাজপুরসহ বিভিন্ন রুটে স্পেশাল ট্রেন চালানোর কথা রয়েছে। অথচ রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, বুড়িমারী বা বাংলাবান্ধা—যার একটি বিশাল যাত্রীঘন অঞ্চল—সেখানে বিশেষ ট্রেন নেই।

সোনার হরিণের মতো রংপুর এক্সপ্রেস
ঈদে বাড়ি ফেরার অন্যতম ভরসা আন্তঃনগর রংপুর এক্সপ্রেস, যার টিকিট পাওয়া যেন রীতিমতো লটারি জেতার মতো ব্যাপার! টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে অগ্রিম, যার ফলে অনেকেই এখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন বিকল্প কোনো পথের দিকে।
আরও পড়ুন
রেলওয়ের লালমনিরহাট ডিভিশন থেকে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার যাত্রী রংপুর, লালমনি, কুড়িগ্রাম, বুড়িমারী, পঞ্চগড়সহ আশপাশের স্টেশন থেকে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। যাত্রীসংখ্যার তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ঈদের সময় যাত্রীসংখ্যা বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি, যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ট্রেন চালানো ছিল অত্যন্ত জরুরি।
আরো পড়ুন: খুলে দেওয়া হলো ঢাকা রংপুর মহাসড়কের চার লেন- যাত্রাপথে সময় কমবে ২ ঘণ্টা
বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তীব্র
রংপুরের যাত্রী আতাউল হক দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন,
“প্রতিবার ঈদ আসলেই মনে হয়, রংপুর কি বাংলাদেশে পড়ে না? দেশের অন্যান্য জায়গায় স্পেশাল ট্রেন যায়, অথচ আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। যাত্রীদের কথা ভাবা হয় না। এ যেন একপ্রকার উপেক্ষা।”
তার মতো অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন, তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে উত্তরাঞ্চলের মানুষের কণ্ঠ যেন শুনতেই পায় না কেউ।
রংপুর শহরের বাসিন্দা রহিমা খাতুন বলেন,
“দেশের সব জায়গায় রেললাইন উন্নত হয়েছে, কিন্তু রংপুরে কোনো উন্নয়ন নাই। টিকিট পাওয়া কঠিন, আর স্পেশাল ট্রেন তো কল্পনাই করা যায় না। কত বছর এই অবহেলা চলবে?”
রেলওয়ের যুক্তি ও ব্যাখ্যা—তৃপ্তি কি তাতে?
রংপুর রেলস্টেশনের সিনিয়র সুপার শংকর গাঙ্গুলি জানান,
“রংপুর এক্সপ্রেস ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস রংপুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে চলাচল করে। এছাড়া পার্বতীপুর ও কাউনিয়া হয়ে কিছু ট্রেন ঢাকায় যায়। কিন্তু স্পেশাল ট্রেনের মধ্যে রংপুরের জন্য কিছুই নেই।”
তার এই বক্তব্য মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি দিলেও প্রশ্ন থেকেই যায়—রংপুর এক্সপ্রেস আর কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস তো প্রতিদিনই চলে, নতুন করে স্পেশাল ট্রেন না দিলে ঈদের অতিরিক্ত যাত্রীচাপ সামলাবে কীভাবে?
বিশেষ ট্রেনের প্রয়োজনীয়তা কেন এত জরুরি?
সড়কপথে ভোগান্তির কথা নতুন কিছু নয়। ঈদের সময় অতিরিক্ত গাড়ি, যানজট, দুর্ঘটনার ঝুঁকি—এসব মিলিয়ে ট্রেনই সাধারণ মানুষের সবচেয়ে পছন্দের বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রেন সময়মতো ছাড়ে, নিরাপদ, আরামদায়ক এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী।
বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ট্রেনই একমাত্র ভরসা। কিন্তু টিকিট না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে দুর্বল আর ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন বেছে নেন। অনেকে তো বাসের অস্বাভাবিক ভাড়ার কারণে বাড়ি যাওয়ার চিন্তাই বাদ দেন। এমন প্রেক্ষাপটে ঈদ স্পেশাল ট্রেন শুধু আরাম নয়, এক রকম সামাজিক দায়িত্বও বটে।


কেন রংপুর বারবার উপেক্ষিত?
অনেকেই মনে করেন, রংপুর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্বে এখনো অনেক পিছিয়ে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই অঞ্চলকে গুরুত্ব দেওয়া হয় কম, বরাদ্দ আসে কম, আর জনদুর্ভোগের ব্যথা পৌঁছায় না কেন্দ্রে।
রংপুরের শিক্ষক মাহবুবুল আলম বলেন,
“একটা বিভাগীয় শহরের মানুষ যদি বছর বছর এমন বঞ্চনার শিকার হয়, তাহলে কিভাবে বলব আমরা উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছি? বিশেষ ট্রেনের মতো ছোট একটা ব্যাপারে যদি বৈষম্য হয়, বড় বিষয়ে তো বোঝাই যাচ্ছে কী অবস্থা।”
জনপ্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান
রেলওয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা, অঞ্চলভিত্তিক যাত্রীচাপ বিশ্লেষণ এবং জনগণের দাবির প্রতি সম্মান থাকা জরুরি। জনপ্রতিনিধিরাও যেন এই বিষয়ে সংসদ বা প্রশাসনিক পর্যায়ে কথা বলেন, এমন প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
একজন যাত্রী যেমন বলেছিলেন,
“আমাদের এমপিরা যদি কেবল নির্বাচনের সময় না এসে, আমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন, তাহলে রংপুরের ভাগ্যে কিছু একটা জুটত।”
এই অবহেলার শেষ কোথায়?
একটি বিভাগীয় শহর, যার রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা, যাত্রীচাপ, এবং উন্নয়ন সম্ভাবনা—সে শহর যখন জাতীয় সেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে বঞ্চিত হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে প্রশাসনের দায়বদ্ধতা নিয়ে। ঈদ মানেই তো উৎসব সবার জন্য, শুধুই রাজধানী বা নির্দিষ্ট কিছু শহরের জন্য নয়।
রংপুরের এই বারবার বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস যেন আগামী দিনে আর না হয়। ঈদ যেমন সবাইকে একত্রিত করে, সেই আনন্দের পথ যেন বৈষম্যে বাঁধা না পড়ে। মানুষ চায় একটু সমান সুযোগ, একটু সম্মান, আর একটু মানবিকতা।
রেল কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের একটাই বার্তা—“আমরাও এ দেশের নাগরিক। আমাদের দিকেও একবার তাকান।”