বুধবার দুপুর। রংপুর শহরের ব্যস্ততম এলাকা—স্বর্ণপট্টি। প্রতিদিন এখানে শত শত মানুষ আসে, কেউ গয়না কিনতে, কেউ পুরানো স্বর্ণ বদলাতে, আবার কেউ শুধু এক ঝলক দেখে চলে যেতে। এখানে ব্যবসা মানেই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক জগৎ, যেখানে ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে এক ধরনের নীরব চুক্তি চলে—‘আমি তোমার উপর বিশ্বাস করছি, তুমিও করো।’
কিন্তু সেই বিশ্বাসের ভিত্তিই যেন এক নিমেষে ভেঙে পড়ে বুধবার দুপুরে লক্ষ্মী জুয়েলার্সে ঘটে যাওয়া এক অবিশ্বাস্য ঘটনায়। ক্রেতা সেজে স্বর্ণের দোকানে দেড় কোটি টাকার অলংকার চুরি করে পাঁচ নারী- এই ঘটনা যেনো সিনেমাকে হার মানায়- চলুন জানি বিস্তারিত….
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
ঘটনার শুরু: পাঁচ নারী, এক বোরকা, আর এক ছকবদ্ধ পরিকল্পনা
দুপুর প্রায় ১টা বাজে। দোকানে ক্রেতা কম, মালিক তীলক বসাক নিজেই গহনার বক্স গোছাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই দোকানে প্রবেশ করেন পাঁচজন নারী। প্রত্যেকেই বোরকা পরা, মুখ ঢাকা। দোকানের কর্মচারীরা শুরুতে ভেবেছিলেন, হয়তো ঈদের বাজার চলছে, নতুন গয়না কিনতে এসেছেন। কিন্তু কারো কল্পনাতেই আসেনি, এরা সবাই একজন পেশাদার চোরচক্রের সদস্য।
এই পাঁচজন নারী চুপচাপ দোকানে ঢুকে প্রথমে একটি বানানো গয়নার বক্স দেখতে চান। গয়নার প্রতি নারীদের আকর্ষণ চিরকালীন—তাই দোকানদারও সন্দেহ না করে তাদের দেখাতে থাকেন একের পর এক আইটেম। আংটি, চেইন, লকেট—সবই তারা দেখতে চায়। দোকানদারও আন্তরিকভাবে দেখান, যেভাবে একজন ব্যবসায়ী একজন সম্ভাব্য ক্রেতার সাথে ব্যবহার করেন।
কিন্তু এখানে ছিল অন্য এক খেলা। দোকানদার যখন সামনে রাখা বক্স থেকে গয়না বের করছেন, তখন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে বক্সটি চোখের আড়ালে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেন। দুইবার ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয়বার সে সফল হয়। আর তার বাকিরা—মনে হচ্ছিল যেন কোরিওগ্রাফি করা কোনো নৃত্য, কেউ দোকানদারকে কথায় ব্যস্ত রাখছে, কেউ আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে।
আরো পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম বিকাশে পেমেন্ট – কোনো ইনভেস্ট ছাড়াই ঘরে বসে আয় শুরু করুন!

চোরদের নাটক: এক আনার আংটির মোড়কে কোটি টাকার লুট
বিষয়টি যাতে দোকানদারের মনে সন্দেহ না জাগে, সে জন্য এই পাঁচ নারী একটি এক আনা ওজনের স্বর্ণের রিং কিনে টাকা দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যান। তাদের আচরণ এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে কেউ বুঝতেই পারেননি কি ঘটে গেছে।
মাত্র কয়েক মিনিট পরেই তীলক বসাক যখন লক্ষ্য করেন প্লাস্টিকের বক্সটি নেই, তখন মাথায় বাজ পড়ে তার। ভেতরে ছিল প্রায় ৫০ ভরি স্বর্ণের চেইন, ৩০ ভরি স্বর্ণের আংটি, ১২ ভরি লকেট, আর ৮ ভরি ব্রেসলেট—সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার গয়না।
আরও পড়ুন
একজন ছোট ব্যবসায়ীর জন্য এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, এক ধাক্কায় হৃদয়ের ভেতর একটা গভীর ক্ষত।
সিসিটিভি ফুটেজ: চুরির নিখুঁত সিনেমাটিক চিত্রনাট্য
বিকেলের মধ্যে দোকানে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়। যা দেখা গেল, তাতে চোখ আটকে যায়। ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিভাবে পাঁচজন নারী তাদের ভূমিকা ভাগ করে নিয়েছে। একজন দোকানদারকে কথায় ব্যস্ত রেখেছেন, একজন আশেপাশের দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছেন, একজন গয়নার বক্সটি লক্ষ্য করছেন, আর একসময় সেটি তুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলছেন।
এই কাজটি তারা এমনভাবে করেছেন, যেন এটি তাদের বহুবার অনুশীলিত কোনো মিশন।
মামলার আবেদন: তীলক বসাকের ভাঙা কণ্ঠে আর্তি
ঘটনার পরপরই তীলক বসাক থানায় অভিযোগ জানান। কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, তারা ইতিমধ্যে অভিযোগ পেয়েছেন এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত শুরু করেছেন।
একজন সাংবাদিক হিসেবে যখন তীলক বসাকের সাথে কথা বলছিলাম, তার চোখে ছিল আতঙ্ক, ক্ষোভ এবং হতাশা—তিনটি আবেগের এক জটিল মিশ্রণ। “ভাই, ব্যবসাটা আমার জীবনের ২৫ বছরের স্বপ্ন। এইভাবে এক ঝটকায় শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি,”—বলছিলেন তিনি।
মানবিক দৃষ্টিকোণ: চোরদের গল্প আমরা জানি না, তবে…
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসে—এই নারীরা কি পেশাদার অপরাধী? নাকি তারা কোনো চক্রের চাপে পড়ে এমন কাজ করেছে?
আমরা হয়তো কখনো জানতে পারব না তারা কে, কোথা থেকে এসেছে। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, এমন ঘটনা একজন ব্যবসায়ীকে শুধু আর্থিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ধ্বংস করে দিতে পারে। তীলক বসাক হয়তো এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন না কখনোই।
আরো পড়ুন: ফ্রি লটারী খেলে টাকা ইনকাম: ২০২৫ সালে কিভাবে সহজে টাকা আয় করবেন?
রংপুরবাসীর ভয়: কে হবে পরবর্তী টার্গেট?
এই ঘটনার পর রংপুর শহরের অন্য স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও শঙ্কিত। তারা দোকানে নিরাপত্তা বাড়াচ্ছেন, ক্রেতাদের মুখ দেখা ছাড়া প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। কেউ কেউ দোকানে ‘নারী চোর চক্রের’ সতর্কতা পোস্টারও লাগিয়েছেন।
সাধারণ মানুষ যারা স্বর্ণ কিনতে যান, তারাও এখন দ্বিধায় থাকবেন—“এই দোকানে গিয়ে কিছু কিনলে আমার মুখে মাস্ক থাকবে, বোরকা পরলে সন্দেহ করবে না তো?”


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়: তদন্ত কি থেমে যাবে সংবাদ শিরোনামের পরে?
এ ধরনের ঘটনা আমাদের আইনি ব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন তোলে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রথম দিকে তদন্ত জোরালো হয়, কিন্তু কয়েকদিন পর সব থমকে যায়। যদি চোরদের ধরা না যায়, তবে ভবিষ্যতে আরো বড় কোনো চুরি আমাদের সামনেই অপেক্ষা করছে।
রংপুর শহরের জনগণের একটাই চাওয়া—এই ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হোক, এবং এমন নজির স্থাপন করা হোক যেন আর কেউ বিশ্বাসের পুঁজি নিয়ে খেলতে সাহস না করে।
আরও পড়ুন: ফেসবুক স্টোরি থেকে আয়ের সুযোগ: কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুখবর, পারবনে আপনিও
শেষ কথা: স্বর্ণপট্টির আড়ালে একটি ভাঙা মন, একটি হারানো স্বপ্ন
এ গল্প কেবল ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার চুরির নয়। এটি একজন মানুষের আত্মার চুরির গল্প। একজন ব্যবসায়ীর নির্ভরতার জায়গা, তার সারা জীবনের স্বপ্ন, তার পরিবারের নিরাপত্তা—সবকিছু যেন এক নিমিষে হারিয়ে গেছে।
আমরা যারা রংপুরে থাকি, এই শহরটাকে ভালোবাসি, তাদের জন্য এটি কেবল একটি সংবাদ নয়, এটি আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন, আমাদের আস্থার প্রশ্ন।
হয়তো এই ঘটনার বিচার হবে, হয়তো চোররা ধরা পড়বে। কিন্তু তীলক বসাকের চোখের ভেতরে যে অনিরাপত্তার ছায়া নেমে এসেছে—তা হয়তো কোনো আইনি রায়েও মুছে যাবে না।
আপনিও যদি মনে করেন, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, তবে পোস্টটি শেয়ার করুন। একজন ছোট ব্যবসায়ীর পাশে দাঁড়ানোও আজকের দিনে এক ধরনের ইবাদত।
আপনার মতামত জানান, আর পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদেরও জানার সুযোগ দিন।
আপনার সমর্থনই আমাদের উদ্ভাবনের জ্বালানি! আমাদের সৃজনশীল যাত্রার অংশ হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আরও আপডেট ও অন্তর্দৃষ্টির জন্য আমাকে গুগল নিউজ-এ অনুসরণ করতে ভুলবেন না!