রংপুরে আকাশ যেন থামতেই চায় না। টানা কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে পুরো শহর ও আশপাশের এলাকা ডুবে গেছে পানিতে। শহরের অন্তত ২০টি মহল্লা এখন হাঁটু পানি নিচে। শুধু শহর নয়—গ্রামের ফসলের মাঠ, মাছের পুকুর, সবজি খেত—সবই পানির নিচে।
সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন যারা দিন আনে দিন খায়—কৃষক, রিকশাচালক, দোকানদার, দিনমজুর। এই বৃষ্টিতে তাদের স্বপ্ন ভাসছে পানিতে।
সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মাত্র এক রাতেই রংপুরে ১১৮.৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দুই দিনে বৃষ্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৬ মিলিমিটার, যা এই বছরের সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সামনে আরও বৃষ্টি হতে পারে।
এ বৃষ্টির কারণে শুধু জলাবদ্ধতা নয়, ক্ষতির মুখে পড়েছে হাজারো মানুষ—তাদের জীবিকা, ফসল আর প্রতিদিনের জীবনযাত্রা।
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
নগরজুড়ে পানি-পানি, হাঁটতে গিয়েও ভোগান্তি
রংপুর শহরের মানুষ এখন যেন পানির সঙ্গে লড়াই করছে। টানা বৃষ্টিতে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে যেসব এলাকায় শ্যামা সুন্দরী খাল বয়ে গেছে। খালটি অনেক দিন ধরে অপরিচ্ছন্ন, খননও হয়নি—ফলে পানি বের হতে না পেরে উপচে ঢুকে পড়েছে আশপাশের বাড়িঘরে।
মুন্সিপাড়া, জুম্মাপাড়া, বাবুখাঁ, হনুমানতলা, গোমস্তপাড়া, মুলাটোল—এসব এলাকাগুলোর বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রাস্তায় এক থেকে দেড় ফুট পানি জমে আছে। ঘর থেকে বের হওয়া দুঃসাধ্য। অনেকের ঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে গেছে।
লোকজন বলছে, একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে নোংরা পানি—চলাফেরা তো দূরের কথা, ঘরের ভিতরেই আটকে থাকতে হচ্ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ, অফিসগামীদের জন্য শুরু হয়েছে নতুন এক যুদ্ধ।
আরো পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম বিকাশে পেমেন্ট – কোনো ইনভেস্ট ছাড়াই ঘরে বসে আয় শুরু করুন!
আরও পড়ুন


ফসলের মাঠে হাহাকার, কৃষকের মুখে দুঃখের গল্প
রংপুরের মিঠাপুকুরে এখন শুধু পানি আর দীর্ঘশ্বাস। বৃষ্টির পানি জমে পুরো ফসলের মাঠই ডুবে গেছে। ধান, আদা, শাকসবজি—সবই এখন পানির নিচে। কৃষকের চোখে-মুখে আতঙ্ক, কারণ এই জমিই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা।
রানীপুকুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া, তাজনগর, আফজালপুর, ভক্তিপুর আর বলদীপুকুর গ্রামের মাঠগুলো এখন যেন একেকটা ছোট নদী। মাঠে গিয়ে ফসলের কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না—শুধু থৈ থৈ পানি।
এই গ্রামের কৃষক নুর আলী বললেন,
“দেড় বিঘা জমিতে ধান আর আদা লাগাইছিলাম। এখন পুরাটাই পানির নিচে। যদি পানি ক’দিন এরকমই থাকে, সব পঁচে যাবে। দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে—এখন কী করুম!”
নুর আলীর মতো শত শত কৃষক এখন অসহায়। যাদের চোখে ছিল নতুন ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন, সেই চোখে এখন শুধু দুশ্চিন্তা। এই বৃষ্টি থামবে কিনা, পানি নামবে কিনা—তা নিয়েই তাদের দিন কাটছে।
মাছের পুকুরেও বিপর্যয়, পানির সঙ্গে ভেসে গেল স্বপ্ন
শুধু ফসল নয়, টানা বৃষ্টিতে রংপুরের মাছ চাষিরাও পড়েছেন বড় বিপদে। অনেকের পুকুর ভরে গেছে, পাড় ভেঙে মাছ ভেসে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা স্বপ্ন যেন এক রাতেই পানিতে ভেসে গেল।
মিঠাপুকুরের মাহফুজার রহমান নামের এক মাছ চাষি জানান,
“আমার দুইটা পুকুর। এতে প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ আছে। কিন্তু বৃষ্টিতে পাড়ের ওপর দিয়ে পানি চলে যাচ্ছে। পুকুর ঘিরে এখন জাল দিছি, সারাদিন ওটাই দেখতেছি—যেন মাছ বাইর না হয়।”
তিনি আরও বলেন, “পানির চাপ যদি বাড়ে, পাড় ভেঙে গেলেই সব শেষ!”
আরেক চাষি হায়দার আলী, যিনি ২৫ শতক জমির একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন, জানান—
“এবারই প্রথম মাছ ছাড়ছিলাম। এখন সব ভেসে গেছে। একটা মাছও পাই নাই। সব গেলো। আমি তো শেষ।”
এই দুইজনের মতো অনেকেই এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের কষ্ট শুধু টাকার নয়—এটা তাদের শ্রম, সময় আর স্বপ্নের হারানোর কষ্ট।
আরও পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম: 2025 সালের সেরা Apps ও ওয়েবসাইট


দিনমজুর-দোকানদার সবাই কষ্টে, পেট চালানোই এখন চ্যালেঞ্জ
রংপুরের এই টানা বৃষ্টি শুধু জমি বা পুকুরেই ক্ষতি করেনি—সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষরা। যাদের প্রতিদিন রোজগার না হলে রান্না হয় না, পেট চলে না—তাদের কাছে এই বৃষ্টি যেন অভিশাপ।
অটোচালক সাজ্জাদুর রহমান বললেন,
“বাইরে লোকজনই নাই। যাত্রী পাইলেই তো অটো চালাই! দুইদিন ধইরা বেরই হইতে পারি নাই। ঘরে চাল নাই। দেনা বাড়তেছে।”
তার মতো আরও অনেক অটো-রিকশাচালক বৃষ্টির কারণে ঘরেই বসে আছেন। কেউ কেউ রাস্তায় গেলেও যাত্রী নেই, ভাড়া নেই—দিন শেষে খালি হাতে ফিরছেন।
ছোট দোকানদাররাও কষ্টে আছেন। বাজারে লোকজন আসছে না। দোকান খুলে বসে থাকলেও বিক্রি নেই। এক দোকানি জানালেন,
“সারাদিন বসে থাকি, দু’একটা জিনিস বিক্রি হয় কি না! বৃষ্টির দিনগুলা এমনিতেই অলস।”
যাদের আয় প্রতিদিনের, তাদের কাছে এই বৃষ্টি শুধু ভেজা রাস্তাই নয়—এটা নিয়ে এসেছে অনিশ্চয়তা, ঋণ আর না খেয়ে থাকার ভয়।
বৃষ্টির ছুটিতে স্কুল, ক্লাসরুম ফাঁকা
টানা বৃষ্টির প্রভাব পড়েছে রংপুরের স্কুল-কলেজেও। সকাল থেকেই ছিল অঝোর বৃষ্টি আর বজ্রপাত। এমন আবহাওয়ায় অভিভাবকেরা আর শিশুদের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে পাঠাননি। ফলে শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা।
পাইকান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক একরামুল হক জানালেন,
“সকালেই দেখি ছাত্রছাত্রী হাতে গোনা কয়েকজন এসেছে। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। বজ্রপাতও হচ্ছিল। তাই আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি দিয়ে দিই।”
শুধু পাইকান নয়, আশপাশের অনেক স্কুলেই একই চিত্র। শিক্ষকরা স্কুলে এলেও শ্রেণিকক্ষগুলো ছিল প্রায় ফাঁকা। বৃষ্টির শব্দ আর ফাঁকা বেঞ্চের নীরবতা যেন এই দুর্যোগেরই প্রতিচ্ছবি।
শিক্ষা কার্যক্রমে বাধা যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি অভিভাবকদের মনে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা—কবে আবার স্বাভাবিক হবে সব?
আরো পড়ুন: অনলাইন ইনকাম এবার হবেই: রইলো ১০ উপায়, লাগবেনা অভিজ্ঞতা
প্রশাসনের তৎপরতা ও কৃষি অফিসের আশ্বাস
এই বন্যাজনিত দুর্ভোগে প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ পুরোপুরি হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মাঠপর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য।
রংপুর জেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, জেলার ১৭টি ইউনিয়নে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পাশে আছেন। জমিতে গিয়ে সরেজমিনে তথ্য নিচ্ছেন, কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আবেদীন বলেন-
“বৃষ্টির পানি ধানের জন্য কিছুটা সহায়ক হলেও সবজি খাতে ক্ষতির আশঙ্কা আছে। পানি না নামলে সমস্যা বাড়বে।”
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে জানানো হয়েছে, তিস্তা নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে ঠিকই, তবে এখনো তা বিপদসীমার নিচে রয়েছে। যদিও কিছু চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ওইসব এলাকার শস্যে ক্ষতি হয়েছে বলে তারা নিশ্চিত করেছেন।
সরকারি দপ্তরগুলোর দাবি, পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে মাঠে থাকা কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখে এখনো স্বস্তির ছাপ নেই। তাদের প্রত্যাশা—সরকার যেন দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এসে দাঁড়ায়, বিশেষ করে যাদের সবকিছুই পানিতে হারিয়ে গেছে।
শেষ কথা: ভাঙা সপ্নে ভেসে যাচ্ছে জীবন
রংপুরের মানুষ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। চারপাশে শুধু পানি আর পানি—ডুবে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের পুকুর, দোকানপাট, এমনকি স্কুল-কলেজও। কারও রোজগার বন্ধ, কারও বছরের সঞ্চয় ভেসে গেছে, আর কারও শিক্ষাজীবন থমকে গেছে।
এই টানা বৃষ্টিতে শুধু জনজীবন নয়, থেমে গেছে আশা-ভরসাও।
খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে। তারা চায় সহায়তা, তারা চায় একটু সাহস—যা দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যায়।
এখনই সময় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, সাহায্য সংস্থা—সবাই মিলে যদি এখন এগিয়ে আসে, তাহলে হয়তো এই মানুষগুলোর মুখে আবার হাসি ফিরবে।
কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামানো না গেলেও, মানুষের পাশে দাঁড়ানো কিন্তু সম্ভব—আর সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।