শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া চাকরি ছেড়েছেন শহীদ আবু সাঈদের দুই ভাই, আবু হোসেন ও রমজান আলী। বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাতে আবু সাঈদের ছোট ভাই আবু হোসেন মুঠোফোনে একটি অনলাইন মিডিয়অকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ব্যক্তিগত কারণে তারা দুজনই বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে ই-মেইল ও ডাকযোগে চাকরি থেকে অব্যাহতির জন্য পত্র পাঠিয়েছেন।
আরো পড়ুন: উত্তরাঞ্চল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগের দাবিতে উত্তাল রংপুর: মহাসড়ক অবরোধ
গত মাসের ৯ অক্টোবর, বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের দুই ভাইকে দুটি পদে নিয়োগ দিয়েছিল। রমজান আলীকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের রংপুর ব্যুরো অফিসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এবং আবু হোসেনকে নিউজ ২৪ চ্যানেলের রংপুর ব্যুরো অফিসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের প্রতিনিধি, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মো. ইয়াসিন হোসেন। তারা শহীদ আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি পীরগঞ্জের বাবনপুরে যান, যেখানে শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের উপস্থিতিতে নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। সেখানে ছিলেন মকবুল হোসেন, তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, ছেলে রমজান আলী, আবু হোসেন, ছোট বোন সুমী বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সেদিন শহীদ আবু সাঈদের ছোট বোন সুমী খাতুনও চাকরি পান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) কর্তৃপক্ষ থেকে।
তবে চাকরি পাওয়ার এক মাস পর কেন দুই ভাই চাকরি ছেড়ে দিলেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আবু হোসেন জানান, তাদের চাকরি ছাড়ার প্রধান কারণ ছিল ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিষয়। তিনি বলেন, “চাকরি পাওয়ার পর থেকে আমরা দুজনই অফিসে সময় দিতে পারিনি। সংসারের কাজ এবং অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে আমাদের পক্ষে অফিসে সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা মাস শেষে শুধু বেতন নিতে চাইনি, তাই চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছি।”
আরও পড়ুন: রংপুরের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে ২০ যমজ শিশু
চাকরি ছাড়ার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকে অবাক হন। আবু হোসেন রাত পৌনে ১০টার দিকে তার ফেসবুক আইডিতে চাকরি ছাড়ার বিষয়টি প্রকাশ করেন। তিনি তার পোস্টে লিখেছেন, “সম্মানিত ফেসবুক বন্ধু এবং সকলকে সালাম। আশা করি সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। গত ১ মাস আগে আমি এবং আমার বড় ভাই রমজান আলীকে বসুন্ধরা গ্রুপের ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং নিউজ ২৪ চ্যানেলে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অ্যাডমিন পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আমরা চাকরি গ্রহণ না করেই অব্যাহতি নিয়েছি। এর পর থেকে আমরা বসুন্ধরা গ্রুপের সাথে কোনো সম্পর্ক বা চুক্তি রাখছি না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন যে, তারা অর্থ বা চাকরির জন্য নয়, বরং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই পদক্ষেপ তাদের পরিবারের কাছেও এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। অব্যাহতি নেয়ার কারণে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা চেয়েছেন।
গত ১৬ জুলাই, পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু দেশব্যাপী আন্দোলনের ঝড় তুলেছিল, যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়। সাঈদের হত্যার পর তার পরিবার ও সমর্থকদের মধ্যে একটি সংগ্রামী মনোভাব তৈরি হয়। এর ফলস্বরূপ, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় পরিবর্তন আনে।
আরও পড়ুন: ধান ও খড় রাখা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছেলের দায়ের কোপে প্রাণ গেল বাবার
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু এবং তার পরিবারের সদস্যদের কর্মকাণ্ড দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তার ভাইদের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তও এই বৃহত্তর আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসেবে দেখা যায়। শহীদ আবু সাঈদের পরিবার বরাবরই সংগ্রামী ছিল এবং তারা কখনোই ব্যক্তিগত লাভের জন্য সংগ্রাম করেনি। তাদের আন্দোলন ও প্রতিরোধ কেবল নিজেদের জন্য নয়, দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার জন্য ছিল।
বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরি ছাড়ার পর, তার ভাইরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, তারা জনগণের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা অনুভব করেন এবং তা থেকে বিচ্যুত হতে চান না। এই পদক্ষেপ শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং বৃহত্তর সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন