ভারতীয়রা ‘হামাস’ পছন্দ করে -প্রণব মুখোপাধ্য়ায়

প্রণব মুখোপাধ্য়ায়

ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের বিষয়ে ভারতের বর্তমান অবস্থানের রূপরেখা মূলত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তৈরি করে দিয়েছিলেন। ২০১৫-র অক্টোবরে, অশান্ত পশ্চিম এশিয়া সফরে গিয়েছিলেন তিনি।

ড. রচনা গুপ্তা, নয়া দিল্লি: ক্রমশ বিশ্ব মঞ্চে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধের প্রভাব। এই বিরোধে ভারত প্রথম থেকেই স্পষ্ট এবং অটল অবস্থান ধরে রেখেছে। প্রথম থেকেই নয়া দিল্লি জানিয়েছে, যে কোনও সন্ত্রাসের বিরোধিতা করবে ভারত। ইজরায়েলে হামাসের সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আবার আল আহলি হাসপতালে রকেট হামলারও নিন্দা করেন তিনি।

আসলে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত যত দীর্ঘ হচ্ছে, ভারতের পক্ষে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে ‘ইজরায়েলের সব পদক্ষেপই ন্যায্য’ এই দৃষ্টিভঙ্গি নিলে কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্ব মঞ্চে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। আমরা চাই বা না চাই, তাতে ক্ষতি হবে ভারতেরও। ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের বিষয়ে ভারতের বর্তমান অবস্থানের রূপরেখা মূলত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তৈরি করে দিয়েছিলেন।

২০১৫-র অক্টোবরে, অশান্ত পশ্চিম এশিয়া সফরে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় বিশ্বের প্রথম নেতা হিসেবে একই সঙ্গে ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর এই সফরের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেই অভিজ্ঞতা, এই অঞ্চলের সমস্যা, বিতর্ক এবং সেই সম্পর্কে ভারতের অবস্থান বুঝতে সাহায্য় করতে পারে।

এই সফরের সময় আমরা এই এলাকায় উত্তেজনার স্পষ্ট অনুভব করেছিলাম। নিরাপত্তার কারণে, আমাদের ভারতীয় সাংবাদিকদের দলকে সাঁজোয়া গাড়িতে করে জেরুসালেমের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য, আমাদের শহরে বের হতে হল রাতের খাবারের পর, গভীর রাতে। এমনকি, সেই সময় ইজরায়েলে ছুরি কেনা নিয়েও প্রচণ্ড কড়াকড়ি ছিল। আমরা জর্ডন থেকে ইজরায়েলে ঢুকেছিলাম। প্রবেশপথে, আমাদের ক্যামেরার সরঞ্জাম এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল। স্ক্যানার ছিল, স্নিফার কুকুর ছিল।

আমরা প্রথমে জর্ডন, তারপর প্যালেস্তাইন এবং তারপর ইজরায়েলে গিয়েছিলাম। ইজরায়েলের সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্যালেস্তিনীয় হিংসা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই দিনই জেরুসালেম যাওয়ার পথে এক বোমা বিস্ফোরণে দু’জন ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছিল। সেই সময় আমরা ইজরায়েলি সংসদের গ্যালারিতে ছিলাম। প্যালেস্তিনীয় হিংসা কীভআবে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করেন নেতানিয়াহু। কিন্তু, কূটনৈতিক কারণে সংসদে তাঁর বক্তৃতার সময় প্রণব মুখোপাধ্যায় ওই ঘটনার উল্লেখই করেননি। ‘জেরুজালেম পোস্টে’ লেখা হয়েছিল, প্যালিস্তিনীয় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে নীরব ভারত।

ইজরায়েল সফরের আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ভারতীয় দলের জন্য একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে আমরা যে যে সুস্বাদু খাবার খেয়েছিলাম, তার অন্যতম ছিস হুমাস। সাদা ছোলা, রসুন এবং জলপাই তেল দিয়ে তৈরি করা হয় সেই পদ। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়েরও খাবারটি খুব পছন্দ হয়েছিল। ঘটনাচক্রে তিনি হুমাসের পরিবর্তে খাদ্যপদটিকে ‘হামাস’ বলে উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতীয়রা হামাস খুব পছন্দ করে। তাঁর সেই উচ্চারণে মন্তব্যে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল ইজরায়েল পক্ষ। কারণ, সেই সময় থেকেই ইজরায়েলের সামনে গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হামাস। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথোপকথনে নেতানিয়াহু জানিয়েছিলেন, হামাসকে ইজরায়েলিরা কোনও ভাবেই সহ্য করবে না।

এবার আসি হামাসের সাম্প্রতিক হামলার প্রসঙ্গে। হামাস হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে ইজরায়েলের নতি স্বীকার করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই প্রেক্ষিতে, এক সংশয়ের সম্মুখীন ভারত। কারণ একদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় ভারত। মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সম্পর্কে যেতে চায়। এই পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ বাঞ্ছনীয় নয়। নিরপেক্ষ থাকাটাই সবচেয়ে বিচক্ষণের কাজ।

সেই কারণেই ইজরায়েলের আগে প্যালেস্তাইন সফরে গিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্য়ায়। আমরা রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসের অতিথি ছিলাম, তাঁর বাসভবনেই রাত কাটিয়েছিলাম। আমাদের আল কুদোস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইজরায়েলি বুলেটে এক প্যালেস্তিনীয় ছাত্রের মৃত্যুতে তা বাতিল করতে হয়েছিল।

তবে, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে, শান্তি আলোচনা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। আগেই বলেছি, হামাসকে নির্মূল করাই ইজরায়েলের সংকল্প। ফলে পুরো গাজা ভূখণ্ড ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নিশ্চিতভাবেই সেই ক্ষেত্রে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাবে মুসলিম এবং আরব দেশগুলি। বাকি বিশ্বকে এই সংঘর্ষের সাক্ষী থাকতে হবে।

(নিবন্ধের মতামত লেখিকার নিজস্ব) সূত্র: টিভি৯