এটি একটি ব্যাপক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটের চিত্র, যা বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের বর্তমান অবস্থার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনকে যে দুর্বল এবং দলীয়কৃত অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাধিক সুপারিশ এবং পরিকল্পনা উঠে এসেছে। তাদের দাবি, এখন থেকে প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রক্রিয়া ও পদোন্নতিতে অযোগ্য ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও এইচএসসি পাসের পরই বিসিএস পরীক্ষা, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সুপারিশ করেন।
আরও পড়ুন: কমছে সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি, শিগগিরই আদেশ জারি
বিসিএস পরীক্ষা এবং প্রশাসন
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়ন: বর্তমান প্রেক্ষিত ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের উদ্বেগ এবং সুপারিশ তুলে ধরেন। তাঁদের মতে, এইচএসসি পাসের পরেই বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া উচিত, যাতে প্রাথমিকভাবে যোগ্য ব্যক্তিরা প্রশাসনে আসতে পারেন।
এই আলোচনা বিসিএসের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে আসার প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন বক্তারা। তাঁদের মতে, জনপ্রশাসনের কার্যক্রম সুষ্ঠু ও দক্ষ করতে হলে প্রশাসনে যোগ্য এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত, পাশাপাশি পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিফলন
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একাধিক উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনকে দলীয়করণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন পদোন্নতি, পদায়ন এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রশাসন কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেনি। এই সময়কালকে ‘লুটেরাদের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রশাসন ছিল না, এটি ছিল একটি দলীয়কৃত সেবা, যা দেশের অর্থনীতি এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া সরকার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যাপক বদলানো হয়েছে। চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের চুক্তি বাতিল, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই এখন বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার আছেন। এর মধ্যে সাবেক মুখ্য সচিব, নির্বাচন কমিশনের সচিব, এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নাম শামিল রয়েছে।
আরও পড়ুন: যে উপায়ে চাকরির জন্য সিভি তৈরী করলে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন
প্রশাসন এবং সিভিল সার্ভিসের দুরবস্থা
প্রশাসনের বর্তমান দুরবস্থা প্রসঙ্গে, মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, “এটাকে কি কোনো সার্ভিস বলা যেত?” তাঁর মতে, সাড়ে ১৫ বছরে জনপ্রশাসন এবং সিভিল সার্ভিসের সেবা কার্যক্রম রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সহযোগী হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা বলেন, প্রশাসনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
এতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। মুখ্য সচিবের ভাষায়, সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে গর্তে প্রশাসন পড়েছিল, তা থেকে উদ্ধারের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। এজন্য শুদ্ধি অভিযান, প্রশাসনের সংস্কার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য সুপারিশ
প্রশাসন সংস্কারের জন্য কর্মকর্তারা বেশ কিছু সুপারিশও করেছেন। তাঁদের মতে, বিসিএস পরীক্ষায় যোগ্যতার গুরুত্ব এবং প্রশাসনের সংস্কারে আরও অনেক সুপারিশ রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়, কারণ দক্ষ প্রশাসন তৈরিতে প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
এছাড়া, কর্মকর্তারা আরও বলেন, জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সৎ সাহস এবং যোগ্যতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার মাধ্যমে প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের সাধারণ জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
একইভাবে, যুগ্ম সচিব সাখাওয়াত হোসেন মন্তব্য করেন, প্রশাসনকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিলে স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, “প্রভাবমুক্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিলে, প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে।”
আরও পড়ুন: ৬ষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি আসছে: শিক্ষক নিয়োগ এক লাখ
অন্য সুপারিশ
সেমিনারে আরও কিছু সুপারিশ উঠে আসে, যার মধ্যে অন্যতম হলো:
- পদায়ন ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
- বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষার প্রবর্তন এবং প্রশাসনিক পদে কর্মকর্তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন।
- অবিলম্বে প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালানো।
- প্রশাসনকে আরও স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে এসে তারা কাজ করতে পারে।
এছাড়া, গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) প্রক্রিয়ায় সংস্কার এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার
সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধ এবং সুপারিশগুলো প্রশাসনিক সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে। বর্তমান প্রশাসন প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে সুপারিশগুলো কার্যকর হলে, তা একটি শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। তবে, এর জন্য প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন এবং যোগ্য, দক্ষ কর্মকর্তাদের কার্যকর নেতৃত্ব।
জনপ্রশাসনে পরিবর্তন আনতে হলে এ ধরনের সুপারিশ এবং পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে প্রশাসন জনগণের সেবায় আরও কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে।