সাধের আনন্দ মঞ্জিল

সাধের আনন্দমঞ্জিল

লেখিকা : সৈয়দাসিদরাতুল মুনতাহা

সেদিন ভোর বেলা যখন অনেক জোরে বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন নিজের অনিচ্ছা সত্বেও স্কুলকে উদ্দেশ্য করে ভিজে ভিজে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার কারণটা উল্লেখ করার আগে বলতে হয় যে আসলে আমরা আমাদের কোনো কিছুর শেষ মুহুর্তকে অধিক গুরুত্ব দেই।

সেদিন এস এস সি পরীক্ষার আগে স্কুলের শেষ ক্লাস ছিলো। তাই এই বৃষ্টিতেই আমাকে যেতে হচ্ছিলো । কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত স্কুলে আর পৌছানো আমার সম্ভব হয় নি। পথে যে আকস্মিক এক ঘটনার সম্মুখিন হবো তা একবারটিও চিন্তা করতে পারি নি।
 
সেই আনন্দমঞ্জিল নামের বাড়িটার সামনে এই ঘন বৃষ্টি তেই হাজারো মানুষের সমাবেশ দেখতে পেলাম।সবাই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহ লাগলো তবে তা কিছুক্ষণের মাত্র। কারণ তখনই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো।
 
 
আমি রাস্তা থেকে একটু উঁকি দিচ্ছিলাম। জানতে চেষ্টা করছিলাম যে আসলে ভিতরে কি ঘটেছে ! দেখতে পেলাম একটা খাটলি। আন্দাজ করতে পারলাম যে কেউ ইন্তেকাল করেছে। সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম একজনকে রক্তাক্ত হাতে কারাবন্দী করার জন্য পুলিশরা নিয়ে যাচ্ছে।
 
আমার চোখ দিয়ে যে কখন অশ্রুগুলো গড়িয়ে পারছিলো বুঝতেই পারি নি । হয়তো তার জন্যই আমার মন কেঁদে উঠছিলো, যে নারী দুর্ভাগার মতো নিজের শেষ মুহুর্তকে উপভোগ করতে না পেরে অত্যাচারিত হতে হতেই শেষ পর্যন্ত সেই নর দানবের হাতেই নিজের প্রাণকে বিসর্জন দিলো। যাকে আমি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে আনন্দমঞ্জিলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির খোপ গুলোর ফাঁক দিয়ে নির্ভিগ্নে পড়ে থাকতে দেখতাম।
 
দু এক বার চোখাচোখিও হয়েছিলো। কিন্তু তার সাহস হয় নি চেঁচিয়ে তাকে বাঁচাতে বলার। সে যে কিভাবে বেঁচে ছিলো এ প্রশ্ন এখনো মনের মাঝে ঘর বেঁধে আছে।
 
সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে আজ দশম শ্রেণি শেষের দিকে। গত পাচঁ বছর ধরে কাউকে দেখিনি সেই নারীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। কেউ আটকায় নি সেই নর দানবকে যে সেই নারীকে অত্যাচার করতো।
 
তবে এখন কেন? তবে এখন কেনো সবাই সেই নারীটির লাশ দেখতে এসেছে? কারো তো অধিকার নেই তার এই মৃত চেহারাকে দেখার! সে বাড়িটা থেকে প্রতিদিন আর্তনাদ শোনা যেত। হ্যাঁ আমি শুনতাম।
 
একবার এমন হয়েছিল যে, সেই আনন্দমঞ্জিলের সামন দিয়ে যাওয়ার সময় প্রচন্ড কষ্টে জর্জরিত কন্ঠে কান্না শুনতে পেয়েছিলাম। তবুও রাস্তায় একটা মানুষকেও দেখতে পাইনি যারা সে আওয়াজ শুনে বের হয়েছিলো। ..কারণ তারা যে মানবিকতা হারিয়েছে। তখন সে মূহুর্তে আমার মনে হয়েছিলো বইয়ের পাতায় কতকিছু লেখা আছে। লেখা আছে, নারী নির্যাতন কমে গেছে। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। যার কারনে সমাজ থেকে এ জঘন্য কাজটি বিলুপ্ত প্রায়। কিন্তু কথাটি যে আদেও সত্য নয়।
আসলে আমরা এখন আর জানতে পারি না যে এ ঘৃণামন্ডিত কাজ হচ্ছে কিনা কারণ আমাদের সমাজের মানুষ এখন স্বার্থপর হয়ে গেছে। আর আগে অন্যায় সম্পর্কে জানতে পারতাম কারণ তারা তখন দলবদ্ধ এবং প্রতিবাদী ছিলো।
 
মানুষের স্বার্থপরতার জন্যই আজ দূর্নীতি, অত্যাচার কোথায় হচ্ছে তা জানা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তবে আজ যেমন তার মৃত্যুতে ব্যাথিত হলাম তেমনই আনন্দও হলো। কারণ শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর তাকে এই আনন্দমঞ্জিলের আনন্দহীনতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। যেখানে সেই নারীর দুর্বিসহ অবস্থায় দেয়ালেরাও কেদেঁ উঠেছিলো কিন্তু মানুষের প্রাণ কাঁদে নি। আমিও আমার শেষ ক্লাসের মুহুর্ত গুলোকে পিছনে ফেলে আসলাম। এক সময় বৃষ্টি থেমে গেলো। ততক্ষনে সবাই চলে গেছে। আমি তখনো সেই রাস্তার ধারেই মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছি। শুধু বাস্তবতা নিয়ে ভাবছিলাম।
 
বাসায় ফিরলাম। মাকে সেই আনন্দমঞ্জিলের ব্যাপারে বলার সুযোগ ও সময় দুটোই হলো না। অনেক খিদে পেয়েছিলো তাই আগেই খেতে বসলাম।
 
একবার যখন মা আমাকে জিজ্ঞেসা করলো আমার ছোট ভাই সিরাজ সেতো আমায় স্কুলে দেখে নি। এবং আমি আজ তার সাথে যাইও নি তবে আমি কোথায় ছিলাম? তখন আমি বলতে আরম্ভ করলাম।
 
মা শোনার পরেই এক গুরুতর কথা বলল। যা শুনতে ঠিক সেই মানুষগুলোর মতো লাগলো যারা কখনো ওই নারীটিকে ভয়ংকর অত্যাচার থেকে বাঁচাতে যায় নি।
 
মা জিজ্ঞেসা করল এবং বলল ,আমি কেনো সেখানে থেমেছিলাম?এমনটা করা যে আমার উচিত হয় নি। আর কখনোই যেনো আমি এমন না করি, মা যে আমাকে ওয়াদাবদ্ধ করতে চায়। আমি উত্তরে তাকে কিছুই বলি নি।
 
পরক্ষণেই মনে পরলো যে, আমি তো ছোট মানুষ । যে কেউ একি কথাই বলবে এবং উপদেশ দিবে। কিন্তু, মানুষ তো ছোট থেকেই শেখে। এ কথা তাদেরকে বোঝায় কে?