গত কয়েক মাসে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব প্রচারিত হয়েছে, যা দেশটির শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলো দ্বারা ছড়ানো হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার নামক তথ্য যাচাই সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানায়, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যম বাংলাদেশের সম্পর্কে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। এসব গুজবের মাধ্যমে ভারতের মিডিয়া অঙ্গনে বাংলাদেশের বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
১. ভুয়া খবরের বিস্তার:
রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর প্রচারিত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুজব প্রচার করেছে রিপাবলিক বাংলা, যা ৫টি গুজব প্রচার করেছে। এরপর রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ এবং লাইভ মিন্ট—যারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি গুজব প্রকাশ করেছে। এছাড়া, রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ এবং আজতক দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশি পর্যটক না আসায় ধস নেমেছে ভারতের পর্যটন ব্যবসায়
২. গুজবের বিষয়বস্তু:
এই ভুয়া খবরগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগ পরবর্তী ভুয়া খোলাচিঠি, যেখানে দাবি করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর তার নামে একটি ভুয়া চিঠি রচিত হয়েছে। এছাড়া, মুহাম্মদ ইউনূসের আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর এবং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি ছিল অন্যতম গুজব। এছাড়া, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূসের ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার তথ্যও ভুল ছিল।
এর পাশাপাশি, আরও কিছু গুজব ছড়ানো হয়েছে যেমন পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসেবে প্রচার করা, এবং ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব। এসব তথ্য ভুল ছিল এবং ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকে তা প্রচারিত হয়েছে।
৩. গুজব ও অপপ্রচার:
রিউমর স্ক্যানার আরও জানায় যে, ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুয়া খবর ও গুজবের মধ্যে আরও একটি ছিল বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ভিডিও প্রচার। এই ভিডিওটি ভারতের প্রতিমা বিসর্জন পরবর্তী ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল, যদিও বাস্তবে এমন কিছু ঘটেনি। এছাড়া, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার ভুয়া তথ্য এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে নানা গুজব ছড়ানো হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।
আরও পড়ুন: ডিজিটাল প্রতারণা: আতঙ্কে ৫৯ হাজার হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক করল ভারত
৪. রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণ:
রিউমর স্ক্যানার সতর্ক করেছে যে, এই তালিকা ভারতীয় গণমাধ্যমের অপতথ্য প্রচারের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরছে না। এই তালিকায় শুধুমাত্র তারা উল্লেখ করেছে, যেগুলি যাচাইযোগ্য তথ্য। এসব গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে, যার ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং জনসাধারণের মতামত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৫. বিশ্লেষকদের মতামত:
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা করা বাংলাদেশি গণমাধ্যম বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক বলেছেন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমর মধ্যে পার্থক্য আছে। সংবাদমাধ্যমে তথ্য যাচাই–বাছাই করে প্রকাশ করতে হয়, কিন্তু ভারতের অনেক গণমাধ্যম এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা।
ফাহমিদুল হক আরো জানান, গুজব ও ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তার পরামর্শ, গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রচারকারী গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো উচিত। এছাড়া, এক্স (সাবেক টুইটার) এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়াতে ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমগুলোর উচিত নিজেদের ইংরেজি সংস্করণ চালু করা এবং অপপ্রচার ঠেকানোর কৌশল তৈরি করা।
আরও পড়ুন: স্ত্রীর মৃত্যুর কয়দিন পর বিয়ে করা যায় গুগল সার্চ দিয়েই স্ত্রীকে খুন
৬. স্বীকারোক্তি ও সঠিক তথ্যের গুরুত্ব:
ফাহমিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে কিছু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা স্বীকার করা উচিত। কিন্তু, যা ঘটেনি, সে সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া উচিত নয়। সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সুনাম বজায় থাকে।
৭. অপপ্রচার মোকাবিলা:
অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হলে, ফাহমিদুল হক বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে নির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করতে হবে। ভুয়া খবরের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচারের জন্য গণমাধ্যমের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তাতে করে, ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুয়া খবর ও গুজব সামাল দেয়া সম্ভব হবে।
ভারতের গণমাধ্যমে ভুয়া খবর ও গুজবের ছড়াছড়ি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সমস্যা তৈরি করেছে। তবে, সঠিক পদক্ষেপ এবং তথ্য যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে এই ধরনের অপপ্রচার রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাথে আরও সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করা এবং নিজের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সঠিক চিত্র তুলে ধরা।