কলকাতার কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক অঞ্চল, যা জনপ্রিয়ভাবে ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত, বর্তমানে এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পর্যটকদের অভাবে কলকাতার বিভিন্ন হোটেল, খুচরা দোকান ও ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারির পর এমন দুর্দিন তারা কখনো দেখেননি। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে কলকাতার এই ব্যবসায়িক অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলাদেশি পর্যটক এর আগমন কমে গেছে। এই পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের জন্য এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসা হ্রাস পেয়ে গেছে।
ঢাকা-শিলিগুড়ি বাস চলাচল বন্ধ: পর্যটক সংকটে বিপর্যস্ত ব্যবসা
বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্যই এক কঠিন সময় চলছে। ঢাকা-শিলিগুড়ি বাস চলাচল বন্ধ থাকায় দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাঁচদিন ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ রুটের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে, যার ফলে ভিসা জটিলতা এবং নেতিবাচক ভারতীয় সংবাদ একযোগে ব্যবসা ও পর্যটন খাতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
শিলিগুড়ি থেকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন একজোড়া বাস চলাচল করতো, কিন্তু বর্তমানে যাত্রী না পাওয়ায় বাস মালিকপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কাউন্টারগুলো ফাঁকা পড়ে থাকায় পরিবহন সংস্থার কর্মীদের আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র আশা ছিল ভারত সরকার যদি আবার ভিসা দেওয়া শুরু করত, তবে হয়তো বাস চলাচল স্বাভাবিক হতে পারতো। তবে বর্তমানে শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভীতির সৃষ্টি হওয়ায়, বাস চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
পূর্ববর্তী পরিস্থিতি অনুযায়ী,
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং, সিকিম, আসাম, বিহারসহ নেপাল, ভুটান এবং চীন সীমান্তে যাওয়ার জন্য সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে শিলিগুড়ি এবং বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রেন মিতালী চলাচলও আগস্ট মাস থেকে বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে বাস চলাচলের উপরও চরম প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া, হোটেল ব্যবসায়েও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শিলিগুড়ির বিভিন্ন হোটেল, বিশেষ করে হাসমি চক, মহাত্মা গান্ধী চক, জংশন, মাল্লাগুড়ি, এবং বিধান মার্কেট এলাকার হোটেলগুলোতে বাংলাদেশী পর্যটকদের অভাব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের শিলিগুড়িতে যাতায়াত কমে যাওয়ায় হোটেল মালিকরা অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
এই পরিস্থিতি শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী ও পরিবহণ সংস্থার কর্মীদের জন্য এক কঠিন সময়ের সৃষ্টি করেছে। যাত্রীদের অভাবে তাদের আয় রোজগার এবং ব্যবসা থমকে গেছে। এর মধ্যেই, তারা ভারত সরকারের কাছে ভিসা চালুর আবেদন জানিয়েছে, কারণ তাতে তাদের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তা শুধুমাত্র পরিবহন খাতকেই নয়, বরং শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য খাতেও প্রভাব ফেলেছে। বহু মানুষ শিলিগুড়ি আসতেন চিকিৎসা ও শিক্ষা সম্পর্কিত কাজের জন্য, কিন্তু সেই প্রবাহও এখন তলানিতে পৌঁছেছে।
এই সংকট যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় স্বাভাবিক করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব কতটা মুখে আর কতটা কাজে!
কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’ অঞ্চলে সংকট
কলকাতার ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন এলাকা যেমন মারকুইস স্ট্রিট, সাডার স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, এবং এলিয়ট রোডে অবস্থিত ১২০টি হোটেলের বেশিরভাগ কক্ষ খালি পড়ে রয়েছে। যেখানে গত বছর এই সময় প্রায় ৮০ শতাংশ কক্ষ পূর্ণ থাকত, সেখানে এখন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ কক্ষে অতিথি আছেন। বাংলাদেশের পর্যটকদের অভাবের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কলকাতা হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্য মনোতোষ সরকার বলেন, ‘‘গত বছর বাংলাদেশি পর্যটক এর জন্য ২৬-২৮টি কক্ষ বরাদ্দ ছিল, কিন্তু এখন তা কমে ৪-৫টিতে নেমে এসেছে।’’
আরও পড়ুন: ‘মিনিস্ট্রি অব সেক্স’ চালু করতে চায় রাশিয়া, কিন্তু কেন?
এমনকি কলকাতার নিউ মার্কেট, যা একসময় বাংলাদেশি ক্রেতাদের জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে ব্যবসায়ীদের দুর্দশা বেড়ে গেছে। নিউ মার্কেটের চকোনাট নামক দোকানের মালিক মো. শাহাবুদ্দিন জানান, ‘‘আগে আমাদের বিক্রি ছিল সাড়ে ৩ লাখ রুপি, যা এখন কমে ৩৫ হাজার রুপি হয়ে গেছে।’’
এছাড়া, কলকাতার একটি ১২৪ বছরের পুরোনো প্রসাধনী দোকান, ‘রয়্যাল স্টোর’-এর মালিক অজয় শাহা জানান, ‘‘আগে প্রতি দিন আমাদের দোকান থেকে ২৫-৩০ জন বাংলাদেশি ক্রেতা পণ্য কিনতেন, কিন্তু এখন সেই সংখ্যা কমে মাত্র পাঁচজনের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে।’’
ভারতীয় ভিসা নীতির কঠোরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব
বাংলাদেশি পর্যটক কমতে শুরু করার প্রধান কারণ হলো ভারতীয় ভিসা নীতির কঠোরতা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা। ২০২৩ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রধান কারণ, ভারত সরকারকে ভিসা প্রক্রিয়া সীমিত করতে বাধ্য করে।
ভারত সরকার বর্তমানে শুধুমাত্র চিকিৎসা এবং জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশিদের ভিসা ইস্যু করছে। ফলে, বাংলাদেশের পর্যটকরা কলকাতা আসতে পারছেন না, এবং এর ফলস্বরূপ মিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিরাট ধাক্কা লেগেছে।
ব্যবসায়ীদের দুর্দশা
কলকাতার ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য বাংলাদেশি পর্যটকরা এক ধরনের সোনালী হংসী ছিল, যাদের মাধ্যমে ব্যবসা অনেক ভালো চলত। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। বিশেষ করে কলকাতার হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং দোকানগুলোর মালিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০২০ সালের আগে যখন ভারতের ভিসা নীতি ছিল সহজ, তখন কলকাতার হোটেলগুলো বাংলাদেশি অতিথিদের সাথে পূর্ণ থাকত। গত বছর যেখানে ৮০ শতাংশ কক্ষ পূর্ণ থাকত, সেখানে এখন তা মাত্র ১০-১৫ শতাংশে নেমে গেছে। হোটেল মালিকরা জানাচ্ছেন, ‘‘এটি একটি বিরাট বিপর্যয়। এমন পরিস্থিতি আগে কখনো দেখেনি কলকাতার ব্যবসায়ী মহল।’’
আরও পড়ুন: মাদরাসাবিরোধী আইন বাতিল করলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
এদিকে, নিউ মার্কেটের দোকানগুলোতে বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী তাদের কর্মচারী সংখ্যা কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দোকানদাররা জানাচ্ছেন, ‘‘যতটুকু বিক্রি হতো, তার একাধিক অংশ বাংলাদেশের ক্রেতাদের থেকেই আসত। তবে এখন সেই বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।’’
ভারতীয় ভিসা নীতি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্পর্ক
ভারতীয় ভিসা নীতির পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা মিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং তারপরে ভারতীয় ভিসা ইস্যুর কঠোরতা মেঘমালা হয়ে কলকাতার এই বিশেষ ব্যবসায়িক অঞ্চলটির উপরে আছড়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি শুধু কলকাতা নয়, পুরো ভারতের অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা অশুভ প্রভাব ফেলেছে।
ভারত সরকার জানিয়েছে যে তারা শুধুমাত্র চিকিৎসা বা জরুরি প্রয়োজনে ভিসা ইস্যু করবে। এর ফলে, ভারতের অন্যান্য শহরগুলো থেকেও বাংলাদেশের নাগরিকরা ভিসা প্রক্রিয়া জটিলতার কারণে ভ্রমণে আসতে পারছেন না, যা কলকাতার মিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভিসা সম্পর্কের অস্থিরতা, রাজনৈতিক চাপ এবং অর্থনৈতিক সংকটের ফলে কলকাতার ব্যবসায়ীদের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভবিষ্যত সম্ভাবনা এবং সমাধান
কলকাতার ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, যদি ভারতীয় ভিসা নীতি শিথিল হয় এবং বাংলাদেশি পর্যটক রা কলকাতা ভ্রমণে আসতে সক্ষম হন, তবে আবারও তাদের ব্যবসার গতি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এ জন্য ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাছাড়া, কলকাতার মিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের জন্য নতুন বিপণন কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হস্তশিল্প মেলা বা বিশেষ ছুটির দিনে বাংলাদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য বিশেষ প্রস্তাব তৈরি করা।
এছাড়া, কলকাতা শহরের ব্যবসায়ীদের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে আরও কিছু সুসংহত নীতি তৈরি করতে হবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক সিস্টেমের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হবে।
মোটকথা, কলকাতার মিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন, তবে যদি ভারতীয় ভিসা নীতি শিথিল হয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে, তবে আবারও সেগুলোর অবস্থা পাল্টে যেতে পারে।
3 thoughts on “বাংলাদেশি পর্যটক না আসায় ধস নেমেছে ভারতের পর্যটন ব্যবসায়”