সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ পাচ্ছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা- তবে এই সুবিধা সবাই পাবেন না। জেনে নিন কারা, কীভাবে এবং কোন শর্তে এই ঋণ পাবেন।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিনই নিয়মিত আজান দেন মুয়াজ্জিনরা, আর নামাজে ইমামতি করেন ইমামরা। ধর্মীয় এই নেতারা শুধু মসজিদের দায়িত্বই পালন করেন না, বরং সমাজের নৈতিক উন্নয়নে, মানুষের কল্যাণে ও পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষায় পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই শ্রেণির মানুষদের জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেক সময়ই নিশ্চিত থাকে না।
এমন বাস্তবতায়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট হয়ে উঠেছে তাদের জীবনের ভরসাস্থল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের অসংখ্য ইমাম ও মুয়াজ্জিন পাচ্ছেন সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ এবং প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
চলতি অর্থবছরে বিতরণ হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ টাকা
ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৬০০ জন ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ। পাশাপাশি ৪,৬২০ জন অসচ্ছল ইমাম-মুয়াজ্জিনকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে এই দুই খাতে মোট ৪ কোটি ১১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে। এর মধ্যে ঢাকা জেলার ২৯৫ জন ইমাম ও মুয়াজ্জিন পেয়েছেন ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন
এই অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়া এখনও চলমান। দেশের প্রতিটি জেলার নির্বাচিত ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা ধাপে ধাপে পাচ্ছেন এই সহায়তা।
আরো পড়ুন: ১০ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মোবাইল ২০২৫ – বাজেটের মধ্যেই স্মার্টফোন কিনুন!


সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ পাচ্ছেন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা, তবে কারা পাচ্ছেন এই ঋণ?
সুদমুক্ত এই ঋণ পাচ্ছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা এই একাডেমি দীর্ঘদিন ধরে দেশব্যাপী ইমাম-মুয়াজ্জিনদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যারা ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক কাজেও যুক্ত হচ্ছেন, তাদেরকে ঋণ সহায়তা দিয়ে সমাজে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার।
মানবিকতার গল্প: সুদ ছাড়াই আশার আলো
বিভিন্ন জেলার ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ক্ষুদ্রঋণ অনেকের জীবনে আশার আলো হয়ে এসেছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার এক ইমাম বলেন:
“আমি ছোট একটি মাদ্রাসা চালাই। আগের মতো মানুষ এখন আর তেমন দান করে না। এই সুদমুক্ত ঋণে আমি ছোট একটি বইয়ের দোকান খুলেছি। এখন পরিবার নিয়ে একটু স্বস্তিতে চলতে পারি।”
নরসিংদীর এক মুয়াজ্জিন বলেন:
“অসুস্থ ছেলেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণে ডুবে গিয়েছিলাম। কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করেছি। এখন আর দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম ভাঙে না।”
এই ছোট ছোট গল্পগুলোই প্রমাণ করে, একটা ক্ষুদ্র সহায়তা কত বড় স্বস্তির পরিণতি দিতে পারে।
কল্যাণ ট্রাস্ট: গঠনের ইতিহাস ও উদ্দেশ্য
২০০১ সালে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট মূলত অসচ্ছল ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের আর্থিক সহায়তা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত হয়।
ট্রাস্টের মূল লক্ষ্যগুলো হলো:
- সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান
- দুর্ঘটনায় আহত বা পঙ্গু ইমাম-মুয়াজ্জিনদের চিকিৎসা সহায়তা
- আকস্মিক মৃত্যু হলে পরিবারকে আর্থিক অনুদান
- মেধাবী সন্তানদের শিক্ষা সহায়তা
- পরিবারিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ
এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ, যা আমাদের ধর্মীয় সেবকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলতার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
সংখ্যাগুলো যা বলছে:
খাত | উপকারভোগী সংখ্যা | বিতরণকৃত অর্থ |
---|---|---|
সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ | ৬০০ জন | ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা |
আর্থিক সহায়তা | ৪,৬২০ জন | ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা |
ঢাকা জেলার অনুদান | ২৯৫ জন | ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা |
মোট বিতরণ | ৫,২১৫ জন | ৪ কোটি ১১ লাখ টাকা |
শুধু অর্থ নয়, স্বীকৃতি ও সম্মানও
ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি সমাজের শিক্ষাদান, বিবাহ নিবন্ধন, জনসচেতনতা তৈরি এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু অনেক সময়েই তারা অবহেলিত থাকেন, উপার্জনের সুযোগ সীমিত হয়।
এই কল্যাণমূলক উদ্যোগ শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মানের বার্তা বহন করছে। এটি তাদের কাজের মূল্যায়নের একটি শক্তিশালী প্রতীক।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সরকার জানিয়েছে, ভবিষ্যতে এই ট্রাস্টের আওতা আরও বাড়ানো হবে।
বিশেষ করে:
- ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি
- বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা
- পেনশন সুবিধা অন্তর্ভুক্তকরণ
- নারী মুয়াজ্জিনদের (যদি কোন অঞ্চলভেদে থাকেন) জন্য আলাদা ফান্ড তৈরি
এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে, ধর্মীয় নেতারা শুধু নৈতিক দিক থেকেই নয়, আর্থিক দিক থেকেও হবেন অনেক বেশি স্বচ্ছল ও সম্মানজনক অবস্থানে।


ইমাম-মুয়াজ্জিনদের পাশে সরকার
ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের এই পদক্ষেপ একটি উদাহরণ—কিভাবে রাষ্ট্র তার প্রান্তিক ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে পারে। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, বরং একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
এই ধরনের উদ্যোগ যদি ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে ধর্মীয় সেবকরা হবে আরও আত্মবিশ্বাসী, সমাজে তারা আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
শেষ কথা
আমাদের সমাজে ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা বছরের পর বছর নীরবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা শুধু নামাজের নেতৃত্ব দেন না—তারা নৈতিকতা শেখান, মানুষকে ভালোর পথে ডাকেন, শান্তির বার্তা ছড়ান।
তাদের পাশে দাঁড়ানো মানেই আমাদের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা।
ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের এই সহায়তা তাই শুধু একটি অর্থ নয়—এটি একটি সম্মান, স্বীকৃতি এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আপনার এলাকায় কেউ যদি এই ট্রাস্টের আওতায় পড়েন, তাকে জানাতে পারেন। আপনি নিজেও চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য নিতে পারেন।
আর এই মানবিক উদ্যোগের খবর আরও ছড়িয়ে দিতে পোস্টটি শেয়ার করুন।