বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকাগুলো যেন বারবারই প্রকৃতির প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কখনও জলোচ্ছ্বাস, কখনও বন্যা, আবার কখনও ঘূর্ণিঝড়। মে মাস আসলেই দেশের মানুষ, বিশেষত উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন—আবারও কী কোনো ঝড় আসছে?
২০২৫ সালের মে মাসেও সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কারণ এবার ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি গভীর নিম্নচাপ থেকে তৈরি হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
ঘূর্ণিঝড় কীভাবে তৈরি হয়?
ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন সাধারণত উষ্ণ সমুদ্রের ওপর সৃষ্টি হয়। যখন সমুদ্রের পানি অত্যধিক গরম হয়ে যায়, তখন তা বাষ্পে পরিণত হয়ে ওপরে উঠে যায়। এই প্রক্রিয়ায় নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় এবং চারপাশের বাতাস ওই শূন্যস্থানে ধাবিত হয়। এর ফলে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে তা একটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। বঙ্গোপসাগর এই ধরণের ঘূর্ণিঝড় তৈরির জন্য একটি আদর্শ স্থান, বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুন এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে।
ঘূর্ণিঝড় শক্তির উৎপত্তি ও গতিপথ
আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র উৎপত্তি হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মধ্যাংশে। এটি প্রথমে একটি সুস্পষ্ট নিম্নচাপ রূপে আবির্ভূত হয় এবং এরপর ধীরে ধীরে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। আবহাওয়াবিদদের ভাষ্যমতে, এটি ভারতের ওড়িশা উপকূল হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বা বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে বাতাসসহ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
আরও পড়ুন: মোবাইল দিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ইনকাম: বিকাশ, নগদ বা রকেটে পেমেন্ট
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র প্রভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও খুলনা। এসব অঞ্চলে উচ্চ জলোচ্ছ্বাস, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি এবং প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নিচু এলাকা ও চরাঞ্চলগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
মানুষ কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে?
উপকূলীয় এলাকার মানুষজন ইতিমধ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছেন। ঘর মজবুত করা, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির মজুদ, গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরানো, নৌকা-ট্রলার নিরাপদ জায়গায় রাখা ইত্যাদি কাজ চলছে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীরা মাইকিং করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন।
আশ্রয়কেন্দ্র ও সরকারি প্রস্তুতি
সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০০-এরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার, পানি, ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় এনজিওগুলো একসাথে কাজ করছে। বিদ্যালয় ও কলেজ ভবনগুলোকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন : ২৪০ টাকা ফ্রী বিকাশ পেমেন্ট – সত্যিটা কী? অফার নেই, কিন্তু ইনকামের সুযোগ আছে!
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস প্রযুক্তির উন্নয়ন
গত এক দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। স্যাটেলাইট, রাডার ও কম্পিউটার মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে এখন ঘূর্ণিঝড়ের আগমন পূর্বেই নির্ভুলভাবে ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রযুক্তির কারণে মানুষ আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে পারছে এবং প্রাণহানি কমে আসছে।
অতীতের ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি
ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ (২০০৭), ‘আইলা’ (২০০৯), ‘ফণী’ (২০১৯), এবং ‘আমফান’ (২০২০) উপকূলবাসীর জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সিডরেই প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৪ হাজার মানুষ। এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি সচেতন ও প্রস্তুত। ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আগমনেও সেই প্রস্তুতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী করণীয়
ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর শুরু হয় আরেক সংগ্রাম—পুনর্বাসন। গৃহহীন মানুষ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া চাষাবাদ, বিশুদ্ধ পানির সংকট এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবীদের ভূমিকা
রেড ক্রিসেন্ট, ব্র্যাক, ইসলামিক রিলিফসহ বিভিন্ন এনজিও আগাম সতর্কতা প্রচার, শুকনো খাবার বিতরণ, ওষুধ সরবরাহ এবং আহতদের সেবা দিতে সক্রিয় হয়েছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো জনগণকে সচেতন করতে পাড়ায় পাড়ায় কাজ করছে।
আরো পড়ুন: মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করার উপায় খুঁজছেন? রইলো ১০টি পরীক্ষিত সহজ পথ
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
বাংলাদেশ প্রতিবছর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তা পেয়ে থাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়। জাতিসংঘ, ইউএসএইড, জাইকা, বিশ্বব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এই সময়ে সরকারকে সহায়তা করে। ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’র আগমনেও এসব সংস্থার সহযোগিতা প্রত্যাশিত।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ঘূর্ণিঝড়
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় এখন আরও ঘনঘন এবং আরও শক্তিশালী হয়ে দেখা দিচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের পানি গরম হয়ে যাওয়ায় ঝড় সৃষ্টি হওয়ার হার বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো নিম্নভূমি দেশগুলোর জন্য এটি একটি মারাত্মক হুমকি।
জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর উপকূলের সাধারণ মানুষদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বহু মানুষ ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় চলে গেছেন। অনেকে ফসল নষ্ট হওয়ার ভয়ে মাঠে রয়ে গেছেন, আবার কেউ কেউ গবাদিপশুর চিন্তায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বেশ কিছু জেলার স্কুল-কলেজ ইতিমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষি ও মৎস্যখাতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অনেক চাষি ও জেলে জীবন জীবিকার শঙ্কায় ভুগছেন। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা
সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখছে। টিভি, রেডিও, অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে পরিস্থিতির আপডেট জানানো হচ্ছে। এটি মানুষের মধ্যে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করছে।
শেষ কথা
ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ হয়তো শেষ পর্যন্ত খুব বড় ক্ষতি না-ও করতে পারে, তবে আমাদের সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু প্রস্তুতির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। এই প্রস্তুতি শুধু সরকারের নয়, আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে—প্রকৃতি আমাদের বন্ধু, কিন্তু তার রূপ যখন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তখন শুধু একসাথে থেকেই আমরা বাঁচতে পারি।
সংবাদ উৎস: প্রথম আলো, যমুনা নিউজ, যুগান্তর, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ইউনিসেফ বাংলাদেশ, ইউএন ওসিএইচএ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)।