স্ত্রীর অনুরোধে কুমির হলেও আর মানুষ হতে পারেননি নদের চাঁদ

“নিউজের টাইটেল দেখে নিশ্চয়ই আপনার চোখ কপালে উঠে গেছে, তাই না? বিশ্বাস করুন, আর না-ই করুন, এমনই এক ঘটনার সাক্ষী বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার একটি নদীঘাট, যার নাম ‘নদের চাঁদ’। আজও এই ঘাটের সঙ্গে সম্পর্কিত এক কিংবদন্তি স্থানীয়দের মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।” এই ঘাটের ইতিহাস এক সময়ে মানুষের জন্য রোমাঞ্চকর, কিন্তু ভয়ংকর গল্প হয়ে উঠেছিল। “নদের চাঁদ” নামে পরিচিত এক ব্যক্তির অদ্ভুত কাহিনি আজও এলাকাবাসীর মনে গেঁথে আছে। এই ঘটনাটি, যেটি এক দুঃখজনক পরিণতি নিয়ে শেষ হয়েছিল, আজও স্থানীয়দের মধ্যে গল্পের মতো শোনা যায়।

Juger Alo Google News   যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মুল কাহিনী

‘নদের চাঁদ’ ছিলেন এক সাধারণ যুবক, যিনি ছোটবেলায় বড় হয়েছিলেন মাগুরার পাঁচুড়িয়া গ্রামে। তার জীবনের প্রথম অধ্যায় ছিল সাদামাটা, তার বাবা গদাধর মধুমতি নদীতে মাছ ধরতেন এবং পরিবারের মুখে আহার এনে দিতেন। কিন্তু একদিন মাছ ধরতে গিয়ে পদ্মা নদীতে বাবার অকাল মৃত্যু ঘটে। তখন থেকেই সে ও তার মা জীবিকার সংগ্রামে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন।

একদিন ‘নদের চাঁদ’ সংসারী হতে চেয়েছিলেন, তবে তিনি কখনোই তার মনের শান্তি খুঁজে পেতেন না। ঘরে আটকে থাকার বদলে তার মন ছিল বাহিরে, অজানার পথে। দশ বছর পর তিনি আবার ফিরে আসেন। এখন তার মায়ের বয়স হয়ে গেছে অনেক। তবে এবার তার জীবন ফিরে পাওয়ার পালা ছিল। ‘নদের চাঁদ’ তখন বিয়ে করে স্ত্রীর সঙ্গে এক শান্তিপূর্ণ জীবন শুরু করেন।

আরও পড়ুন: একজন মানুষের প্রতিদিন কত টাকা আয় হলে, সেই মানুষটি সুখী হতে পারবে?

তবে তার জীবনের অদ্ভুত মোড় আসতে দেরি হয়নি। একদিন, তার স্ত্রীর শখ পূরণের জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন এক ভয়াবহ জাদু বিদ্যা শিখে কুমিরে পরিণত হবেন। এই বিদ্যা তিনি শিখেছিলেন কামরূপ (আসাম) থেকে, যেখানে এক নারী তাকে কুমির হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। স্ত্রীর দৃঢ় অনুরোধে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গভীর রাতে দুটি পাত্রের পানিতে মন্ত্র পড়ে শরীরের উপর এক পাত্রের পানি ছিটালে কুমির হয়ে যাবেন, অন্য পাত্রের পানি ছিটালে আবার মানুষের রূপে ফিরবেন।

জীবন চিরকাল কুমিরে পরিণত হলো

কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে। যখন ‘নদের চাঁদ’ কুমিরে পরিণত হন, তখন তার স্ত্রীর পায়ের ধাক্কায় অন্য পাত্রের পানি মাটিতে পড়ে যায়। এর ফলে সে আর মানুষ হতে পারেননি। তার জীবন চিরকাল কুমিরে পরিণত হলো।

এ ঘটনার পর, স্থানীয়রা জানতে পারেন, ‘নদের চাঁদ’ আর কখনো মানুষের রূপে ফিরবেন না। কিছুদিন পর, কামরূপ থেকে তার জাদু শিক্ষক এসে জানিয়ে দেন, তার কুমির হয়ে যাওয়া আর পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তবে মধুমতি নদীর পাড়ে তার মা, মৃত কুমির ‘নদের চাঁদ’ এর দিকে চেয়ে চোখের জল ফেলতেন। মায়ের স্মৃতি আজও এলাকায় টিকে আছে।

আরও পড়ুন: অন্যের বিয়ে ভেঙে মাসে আয় করেন লাখ টাকা

কিছুদিন পর, একদল বণিক যখন নদী দিয়ে যাত্রা করছিলেন, তখন তারা চরে বিরাট একটি কুমির দেখতে পান এবং সেটি হত্যা করে। পরে জানা যায়, সেই কুমির ছিল ‘নদের চাঁদ’। পরবর্তীতে মৃত কুমিরটি সনাতন রীতিতে সৎকার করা হয়।

আজও মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় ‘নদের চাঁদ’ নামক এই ঘাটটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি স্থানীয়দের জন্য এক কল্পকাহিনির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কাহিনির কারণে আজও এই ঘাটে অনেক মানুষ আসেন, এবং সেখানে তার স্মৃতি বহন করা নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ঘাটের পাশেই রয়েছে ‘নদের চাঁদ’ গ্রাম, বাজার, এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে।

বিশেষভাবে, ‘নদের চাঁদ ঘাট’ এখন একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এ জায়গায় এসে অনেকেই এই কিংবদন্তির কাহিনী জানার জন্য এবং ছবিও তুলতে আসেন। যদিও এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা, তবে এটি মাগুরার মানুষের জন্য এক অমর কাহিনি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন: এক্স মানে কি গুগল? না জানলে জেনে নিন এর বিভিন্ন অর্থ ও ব্যবহার

নদের চাঁদের ঘাট

এখানে বাস করা মানুষদের জন্য ‘নদের চাঁদ’ এক অদ্ভুত ধরনের ঐতিহ্য হয়ে আছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তার কাহিনী আজও শোনা হয়, এবং মানুষ এখনও এই ঘাটে এসে এর ইতিহাসে ডুবে যায়। এমনকি, এই জায়গা থেকে অনেক দর্শকও আসে প্রতিদিন, এবং তারা সেখানে একটি নিঃশব্দ শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যায়।

‘নদের চাঁদের’ এই অসাধারণ এবং দুঃখজনক কাহিনির মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়, যে কোনো স্থানীয় কিংবদন্তি বা কাহিনীর মাধ্যমে কোনো জায়গার ঐতিহ্য অমর হয়ে উঠতে পারে। এই কাহিনি যেমন স্থানীয় জনগণের মধ্যে অমলিন, তেমনি এটি তাদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

উপসংহার

মাগুরার “নদের চাঁদ” এর কাহিনি শুধু একটি মিথ নয়, এটি এক বিশাল ঐতিহ্য, যা আজও স্থানীয়দের মধ্যে জীবন্ত। ‘নদের চাঁদ ঘাট’, ‘নদের চাঁদ’ গ্রাম, বাজার এবং বিদ্যালয়গুলো সেই কিংবদন্তির স্মৃতি ধারণ করে রেখেছে। এই গল্প আমাদের শেখায় যে, প্রতিটি জায়গার পেছনে এক অদ্ভুত ইতিহাস বা কিংবদন্তি থাকে, যা সেই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে চিরকাল জীবন্ত রাখে।

Leave a Comment