সিরিয়া বা শাম ভূখণ্ড, ইসলামের ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নবীজির (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে সিরিয়া ভূমির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই ভূখণ্ডের সঙ্গে কিয়ামত পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কিত। চলুন, জানি সিরিয়া সম্পর্কে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর গুরুত্ব কী।
‘মুলকে শাম’ বা শাম ভূখণ্ড ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধুমাত্র ভূগোলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং আল্লাহর বিশেষ বরকত এবং নবী-রাসুলদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে। সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ফিলিস্তিন, পুরোনো মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বর্তমানে শাম ভূখণ্ডের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব ইতিহাসে অপরিসীম। নবী-রাসুলদের অনেকের জন্মস্থান বা হিজরতের স্থান ছিল এই ভূমি, এবং কিয়ামতপূর্ব ভবিষ্যতও এটির সাথে জড়িত।
শাম ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
শামের ভূমি মুসলিমদের জন্য এক পবিত্র স্থান। কোরআন ও হাদিসে শামের বরকত এবং পবিত্রতা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সিরিয়া, জর্দান, লেবানন এবং ফিলিস্তিনের প্রাচীন মুলকে শাম ভূমি একত্রে ইসলামিক ইতিহাসের এক অংশ। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন হজরত ঈসা (আ.), হজরত মুসা (আ.) এবং হজরত ইবরাহিম (আ.)।
শামের পবিত্রতা ও আল্লাহর বিশেষ বরকত
ইসলামের ইতিহাসে শাম ভূখণ্ড একটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, যা ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোর সাথে গভীরভাবে যুক্ত। আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) শামের দিকে হিজরত করেছিলেন, যেখানে তিনি নতুন ধর্মের প্রচার শুরু করেন। তার পরবর্তীতে ঈসা (আ.)-এর জন্ম এবং মুসা (আ.)-এর আগমনও এই অঞ্চলে হয়েছিল।
নবী-রাসুলদের শামে আগমন
শাম ভূমি, বিশেষ করে সিরিয়া, ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। সিরিয়া মুসলিমদের কাছে শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, বরং ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। মুসলিম ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সিরিয়া অনেক নবীর জন্মস্থান ও তাঁদের জীবনসংগ্রামের স্থান।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী
নবী করিম (সা.) শামের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাঁর উক্তি অনুযায়ী, শাম ভূমি শত্রুর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি এবং উম্মতের কল্যাণের সাথে জড়িত। হাদিসে এসেছে যে, শাম ভূখণ্ড এক সময় বিশাল মহাযুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ছাউনি হবে। এছাড়া শাম অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কিয়ামতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে, যা মুসলিম উম্মতের জন্য শীর্ষকৃত ঘটনা হয়ে থাকবে।
১. মুসলিমদের দ্বিতীয় হিজরতভূমি
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোত্কৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে।” এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, শাম ভূমি ভবিষ্যতে মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হয়ে উঠবে। এখানে বাস করলেই তারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করবে, এবং শাম ভূখণ্ডের অধিবাসীরা তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে থাকবে।
২. শামের কল্যাণের সাথে উম্মতের কল্যাণ
শাম ভূমির সাথে উম্মতের কল্যাণ ও অকল্যাণের সম্পর্ক নিবিড়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যখন শামভূমি ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, তখন তোমাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, তারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।” এই হাদিসের মাধ্যমে রাসুল (সা.) শামের ভূখণ্ডকে উম্মতের কল্যাণের মূল উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শাম মাটি থেকে এমন এক শক্তি উদ্ভূত হবে, যা পৃথিবীকে পথ দেখাবে।
৩. আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল শাম দেশে রয়েছেন
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে, শামভূমিতে আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল “আবদাল” থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা ৪০ জনের একটি বিশেষ দল এবং তাদের দ্বারা শামের মানুষ উপকৃত হন। শামের অধিবাসীরা এই বিশেষ দলের বরকত পেয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে এবং তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। এই দলের জন্য আল্লাহ বিশেষভাবে তাদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, এবং তাদের কারণেই শামবাসীদের ওপর আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে।
৪. মহাযুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাছাউনি হবে শাম দেশে
হাদিসে এসেছে, শামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ‘গোতা’ শহরে মুসলিম বাহিনী তাদের সেনাছাউনি গড়ে তুলবে। এই শহরটি দামেস্কের পাশেই অবস্থিত এবং এটি শামের উত্কৃষ্ট শহরগুলোর একটি। মহাযুদ্ধের সময় গোতা শহর মুসলিম বাহিনীর শক্তির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, একদিন শাম অঞ্চলে বসবাসরত মুসলিমরা সেখানে বসবাসের অধিকার লাভ করবে, এবং দামেস্ক নগরী তাদের যুদ্ধকালে আশ্রয়ের স্থান হবে।
৫. কিয়ামতের আগে মাহদির খেলাফত গ্রহণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, কিয়ামতের আগে, মুসলিমদের মধ্যে একটি মতানৈক্য তৈরি হবে এবং এর পর এক ব্যক্তি ইমাম মাহদির হাতে নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি শাম থেকে আসবেন এবং তার হাতে বাইয়াত হওয়ার মাধ্যমে ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে। কিয়ামত পূর্বের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি শামের ভূমিতেই সংঘটিত হবে। ইমাম মাহদির নেতৃত্বে মুসলিমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী হবে এবং ইসলাম বিশ্বের কোণায় কোণায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
৬. ঈসা আ.-এর অবতরণ ও দাজ্জালকে হত্যা
শামের ভূমি কিয়ামতের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, বিশেষ করে ঈসা (আ.)-এর অবতরণের কারণে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, দাজ্জাল শামের মধ্যে থেকে বের হয়ে পৃথিবীজুড়ে ফাসাদ সৃষ্টি করবে। তার শাসনের সময়, ঈসা (আ.) শামের একটি অঞ্চলে, দামেস্ক শহরের পূর্বাঞ্চলের শুভ্র মিনারের কাছে আসবেন এবং তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন। দাজ্জালকে হত্যা করার পর, শাম ভূমি শান্তির অঞ্চল হয়ে উঠবে এবং ইসলাম চূড়ান্ত বিজয় লাভ করবে।
শেষ কথা
সিরিয়া বা শাম ভূখণ্ডের গুরুত্ব ইসলামের ইতিহাসে অপরিসীম। নবী করিম (সা.) এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যা মুসলিম উম্মতের জন্য রোশনি দেখানোর কাজ করবে। শাম ভূখণ্ডের পবিত্রতা ও বরকতের কারণে, এটি কিয়ামতের পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান হিসেবে চিহ্নিত হবে, যেখানে মহান যুদ্ধ, মাহদির খেলাফত গ্রহণ, ঈসা আ.-এর অবতরণ, এবং দাজ্জালকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটবে।
এই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী আমাদেরকে শামের গুরুত্ব এবং তার সাথে সম্পর্কিত ইসলামের মূলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে উদ্দীপ্ত করে।