বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ২০২৫-এর অন্যতম বিতর্কিত এবং উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ ছিল দুর্বার রাজশাহী বনাম রংপুর রাইডার্স। মাঠের লড়াই যেমন নাটকীয় ছিল, তেমনি মাঠের বাইরের ঘটনাগুলোও ছিল সমান আলোচিত।
রাজশাহীর অর্থনৈতিক সংকট, বিদেশি খেলোয়াড়দের ধর্মঘট, এবং বিসিবির বিশেষ অনুমোদন—সব মিলিয়ে এই ম্যাচটি বিপিএলের ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
ম্যাচের পটভূমি: বিতর্কের শুরু
বিপিএল ২০২৫-এর শুরু থেকেই দুর্বার রাজশাহী ফ্র্যাঞ্চাইজিটি নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমত, ফ্র্যাঞ্চাইজিটির মালিকানা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। শফিকুর রহমানের মালিকানাধীন ভ্যালেন্টাইন গ্রুপ আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির মালিক হলেও মালিকানা দাবি করেন আরও কয়েকজন। এর ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজিটির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন: সিলেট স্ট্রাইকার্স বনাম ফরচুন বরিশাল: সিলেটকে বিদায় করে শেষ চারে বরিশাল
খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পরিশোধে বিলম্ব এবং হোটেল বিল বকেয়ার কারণে রাজশাহী শিরোনামে আসে বারবার। চট্টগ্রাম পর্বে খেলোয়াড়রা বকেয়া পারিশ্রমিকের প্রতিবাদে অনুশীলন বর্জন করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের বকেয়া পরিশোধ না করায় ফ্র্যাঞ্চাইজির ব্যবস্থাপককে আটকে রাখার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনার মধ্যেই রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচটি নতুন করে বিতর্ক উসকে দেয়।
বিশেষ অনুমোদন: নিয়ম ভাঙার নজির
বিপিএলের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ম্যাচে অন্তত দুইজন এবং সর্বোচ্চ চারজন বিদেশি খেলোয়াড় দলে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটাররা বকেয়া পারিশ্রমিক না পাওয়ার কারণে খেলতে অস্বীকৃতি জানান এবং দলের সঙ্গে মাঠেও আসেননি। ফলে রাজশাহী শুধুমাত্র স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠে নামার জন্য বিসিবির টেকনিক্যাল কমিটির কাছে বিশেষ অনুমোদন চায়।
বিসিবি “টুর্নামেন্টের বৃহত্তর স্বার্থে” এই অনুরোধ মঞ্জুর করে এবং ম্যাচটি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান রকিবুল হাসান জানান, “দুর্বার রাজশাহী বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে সমস্যায় আছে বলে জানিয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় আমরা তাদের অনুমতি দিয়েছি।” তবে এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে প্রশ্ন থেকেই যায়—বিদেশি খেলোয়াড়দের না থাকার যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা ছাড়াই কীভাবে এই অনুমোদন দেওয়া হলো?
দুর্বার রাজশাহী বনাম রংপুর রাইডার্স মাঠের লড়াই: নাটকীয় জয়
রাজশাহী প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২০ ওভারে মাত্র ১১৯ রান সংগ্রহ করে। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ২৮ রান করেন সানজামুল ইসলাম, যা তাদের স্কোরকে কিছুটা হলেও সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যায়। রংপুর রাইডার্সের শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে রাজশাহীর ব্যাটসম্যানরা বড় স্কোর গড়তে ব্যর্থ হন।
আরও পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম: 2025 সালের সেরা Apps ও ওয়েবসাইট
জবাবে, রংপুর রাইডার্স ইনিংসের শুরুতেই ধাক্কা খায়। মাত্র ৩০ রানের মধ্যে তারা হারিয়ে ফেলে ৬টি উইকেট। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী এবং তাসকিন আহমেদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে রংপুর চাপে পড়ে যায়। তবে অষ্টম উইকেটে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন এবং রাকিবুল হাসানের জুটিতে ম্যাচ জমে ওঠে।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য রংপুরের দরকার ছিল ২৫ রান। সাইফুদ্দিন প্রথম দুই বলে টানা দুটি ছক্কা মেরে সমীকরণ সহজ করে ফেলেন—৪ বলে দরকার মাত্র ১৩ রান। কিন্তু পরবর্তী দুই বল ডট হওয়ায় চাপ বেড়ে যায় এবং শেষ দুই বলে ১০ রান তুললেও তা যথেষ্ট হয়নি। রংপুর ২০ ওভারে ১১৭ রানেই থেমে যায়, আর রাজশাহী পায় নাটকীয় এক জয়।
রাজশাহীর আর্থিক সংকট: মাঠের বাইরের নাটক
রাজশাহীর এই জয়ের পেছনে যেমন তাদের খেলোয়াড়দের লড়াকু মানসিকতা কাজ করেছে, তেমনি মাঠের বাইরের ঘটনাগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিদেশি খেলোয়াড়দের মাত্র ২৫% পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়েছিল, যেখানে নিয়ম অনুযায়ী টুর্নামেন্ট চলাকালীন অন্তত ৭৫% পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।
চট্টগ্রাম পর্বেই ফ্র্যাঞ্চাইজিটি হোটেলের বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের ব্যবস্থাপককে আটকে রাখা হয়েছিল। ঢাকার হোটেলেও একই সমস্যা দেখা দেয়, যেখানে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের কম ভাড়ার একটি হোটেলে স্থানান্তর করতে বলে। এমনকি সেই হোটেলও সংস্কারের কাজ চলমান অবস্থায় ছিল।
আরও পড়ুন: রিয়াল মাদ্রিদ বনাম ভ্যালাডোলিড: কিলিয়ান এমবাপে তার প্রথম হ্যাটট্রিক নিয়ে জয়ী
ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক শফিকুর রহমান অবশ্য শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন যে, কোনো আর্থিক সমস্যা নেই এবং সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে একটার পর একটা ঘটনার কারণে তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
রংপুর রাইডার্স: শীর্ষ দল হলেও চাপে
রংপুর রাইডার্স বিপিএল ২০২৫-এর অন্যতম শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত ছিল এবং পয়েন্ট তালিকার শীর্ষেও অবস্থান করছিল। তবে রাজশাহীর বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় পরাজয়ে তারা কিছুটা হলেও চাপে পড়েছে। বিশেষ করে শেষ ওভারে সাইফুদ্দিনের ব্যর্থতা তাদের জন্য হতাশাজনক ছিল।
দুর্বার রাজশাহীর পুনরুত্থান: দুর্বল থেকে দুর্বার
এই জয়ের মাধ্যমে দুর্বার রাজশাহী নিজেদের প্লে-অফ দৌড়ে টিকিয়ে রাখে এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে সক্ষম হয়। যদিও তারা পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিতি পেয়েছিল, কিন্তু মাঠে তাদের পারফরম্যান্স প্রমাণ করেছে যে তারা এখনো লড়াই করার ক্ষমতা রাখে।
উপসংহার: ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা
দুর্বার রাজশাহী বনাম রংপুর রাইডার্স ম্যাচটি কেবল একটি ক্রিকেট ম্যাচ নয়; এটি ছিল বিপিএলের নিয়ম-কানুন, ব্যবস্থাপনা এবং টুর্নামেন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলে ধরার একটি উদাহরণ। রাজশাহীর আর্থিক সংকট থেকে শুরু করে বিসিবির বিশেষ অনুমোদন—সব কিছুই ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।
বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়ানো যায় এবং প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে। অন্যথায়, এমন বিতর্কিত ঘটনা বিপিএলের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
দুর্বার রাজশাহী এই ম্যাচ দিয়ে প্রমাণ করেছে যে মাঠের বাইরে যতই সমস্যা থাকুক না কেন, মাঠে তারা এখনো “দুর্বল” নয় বরং “দুর্বার” হয়ে উঠতে পারে!
2 thoughts on “দুর্বার রাজশাহী বনাম রংপুর রাইডার্স: নতুন কেলেঙ্কারির মধ্যে নাটকীয় জয় রাজশাহীর”