ফিরে দেখা ২০২৩- বছরজুড়ে আলোচিত যত গুজব

গুজব

খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৩ এর শেষ দিন আসছে আর মাত্র একদিন পরে। সালের শুরুতেই বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতি, দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু, মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু এবং অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ২০২৩ সালে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে নেটিজেনরা সর্বত্র গুজব এর মধ্যে ছিলেন।

ফিরে দেখা ২০২৩- বছরজুড়ে আলোচিত যত গুজব

খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৩ বিভিন্ঘন টনা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে ভুল, গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। দেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সারা বছরের কাজগুলো থেকে একনজরে দেখে নেওয়া যাক আলোচিত এমন কিছু ঘটনা।

মেট্রোরেল স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে বাংলা নেই

মেট্রোরেল স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে বাংলা না থাকার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা, গুজব । সামাজিক মিডিয়ায় ছবি ছড়িয়ে পড়ে যে স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে ইংরেজি ও হিন্দিতে গন্তব্য লেখা, কিন্তু বাংলা নেই। তবে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ছিল।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের কোন জেলা কোন পণ্য নিয়ে পরিচিত- জেনে নিন

হিন্দি ভাষা স্ক্রিনে প্রদর্শনের ব্যাপারে জানা গেছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান L&T Construction মেট্রোরেলের স্টেশনের বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক সিস্টেমের কাজ করেছে, তাই হিন্দি ভাষা প্রাথমিকভাবে ডিফল্ট হিসেবে থাকতে পারে। তবে মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা প্রদর্শন করা হয়েছে।

মাশরাফি বিন মোর্তজার সম্পত্তি ৫১০ কোটি টাকার

বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তজার সম্পত্তির পরিমাণ ৫১০ কোটি টাকা হওয়ার দাবি সঠিক নয়। এই তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে যা ভিত্তিহীন, গুজব এবং মিথ্যা।

মাশরাফির সম্পত্তির পরিমাণ কত তা যাচাই করা সম্ভব নয়, তবে এই দাবি অনির্ভরযোগ্য এবং ভিত্তিহীন সূত্র থেকে এসেছে যা রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে। মাশরাফি বিন মোর্তজার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন নড়াইল-২ আসন থেকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য।

বিএনপির কার্যালয়ে রহস্যময় ব্যক্তি

ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ স্থগিত হওয়ার পর, মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফী নামে এক ব্যক্তি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেন। তবে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার নিশ্চিত করেছেন যে আরেফী মার্কিন সরকারের কোনো প্রতিনিধি নন।

ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে যে আরেফীর কাছে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির একটি সম্মানসূচক কন্ট্রিবিউটিং মেম্বারশিপ কার্ড রয়েছে, যা ডোনেশনের মাধ্যমে যে কেউই পেতে পারে। পরবর্তীতে আরেফীকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করার অভিযোগে মামলা হয়।

ইসরায়েলকে ড. ইউনূসের ১০০ কোটি টাকা সহায়তা

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইসরায়েলকে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছেন বলে একটি দাবি ছিল যা চট্টগ্রামের মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রস্তুত করেছিলেন। তবে, বুম বাংলাদেশ এই দাবিটি পরীক্ষা করে এবং তারা দেখেছেন যে এই দাবিটি সঠিক নয়, গুজব ।

ইউনূস সেন্টার নিশ্চিত করেছে যে ড. ইউনূস ইসরায়েলকে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়ার দাবিটি ভুয়া। এই তথ্য সম্পর্কে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সহায়তা নিয়েছে মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য গেছেন, এটি সত্য। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একটি চেকের ছবি দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা নিয়েছেন। কিন্তু এই দাবি ভুয়া বা মিথ্যা ও গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে

ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ভাইরাল হওয়া চেকটি ভুয়া এবং এটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত একটি চেকের সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে। চেকটির অ্যাকাউন্ট নাম এবং নাম্বারটি ভুল, একই চেকে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকাউন্ট নাম্বার রয়েছে, সোনালি ব্যাংকের শাখার নাম ভুল এবং চেকে ভাষাগত অসংগতি রয়েছে

এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “এটা নোংরামি ছাড়া আর কিছু নয়। মির্জা ফখরুল বাপের জমি বিক্রি করে চিকিৎসা ও রাজনীতি করে। আমাকে কেনা সম্ভব নয়।”। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সদস্য ডিপিএস হাসান জাহিদ তুষার গণমাধ্যমকে চেকটি অসত্য বলে নিশ্চিত করেছেন

রাজনৈতিক অঙ্গনে বেড়েছে এআই, ডিপ ফেক ভিডিও

রাজনৈতিক অঙ্গনে এআই ও ডিপ ফেক ভিডিওর ব্যবহার বেড়েছে। বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরীর মুখ বসানো একটি ডিপফেক ভিডিও ৩০ জুলাই প্রচারিত হয়। ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খানের ভিডিওও ডি-আইডি নামের একটি জেনারেটিভ এআই টুল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।

এছাড়া, বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার নামে একটি ডিপফেক ভিডিও জুন মাসে প্রচারিত হয়। এই ভিডিওগুলো ব্যক্তির সম্মানহানি ও রাজনৈতিক বিরোধ, গুজব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার রাজনীতিতে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর এক বড় হুমকি হয়ে উঠছে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে একাধিক ভুল তথ্য

জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছিল তিনি কাবা শরিফে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারবেন এমন দাবি, সৌদি আরবের যুবরাজ বিন সালমান এবং কাবার ইমাম আব্দুল রহমান আল সুদাইসের শোক প্রকাশ এবং তাঁর জানাজায় লক্ষ কোটি মানুষের উপস্থিতি। কিন্তু এই সব দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।

সাঈদীর জীবনে একবার কাবায় প্রবেশ করেছিলেন বলে তাঁর পুত্র সূত্রে জানা গেছে। আব্দুল রহমান আল সুদাইসের কোনো অফিশিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই এবং তাঁর শোক প্রকাশ নিয়ে কোনো বিশ্বস্ত সূত্র পাওয়া যায়নি। সাঈদীর জানাজায় লক্ষ কোটি মানুষের উপস্থিতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সিলেটের মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হকের জানাজার দৃশ্য ছিল।

অভিনেতা জায়েদ খানের জাতিসংঘের পুরস্কার অর্জন

বাংলাদেশি অভিনেতা জায়েদ খান সম্প্রতি ‘হিউম্যানিটারিয়ান লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন, যা তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে জানিয়েছেন। এই পুরস্কার প্রদান করেছে ‘ইনস্টিটিউট অব পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি রিসার্চ’ এবং ‘দ্য হিউম্যানিটেরিয়ান ফোকাস ফাউন্ডেশন’।

তবে এই পুরস্কার জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত নয় এবং এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান জাতিসংঘের সদর দপ্তরের একটি হলরুমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা ভাড়া করা হয়েছিল। জায়েদ খান এই পুরস্কার পাওয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত হলেও দেশের মানুষের এই বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন উৎসাহিত করতে গত ২৪ মে ভিসা নীতির ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর এ ভিসা নীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। তাঁর এ ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১০ জন বিরোধী দলীয় নেতাদের নাম উল্লেখ করে দাবি করা হয়, তাঁরা ভিসা নীতির মধ্যে পড়েছেন।

এ নিয়ে ফেসবুকের থার্ড পার্টি পার্টনার বুম বাংলাদেশ তাদের অনুসন্ধানে জানায়, ভিসা নীতি অনুযায়ী সম্প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ঘোষণা করলেও কারা নিষেধাজ্ঞা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করবে না যুক্তরাষ্ট্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত নামের তালিকাটি ভিত্তিহীন।

নারীর গর্ভ থেকে সাপের বাচ্চা জন্মানো

জুলাই মাসে দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল আরেকটি ঘটনা: ভারতে এক নারী সাপের বাচ্চা জন্মদানের ভিডিও। এই ভিডিওটির ব্যাপকতা এমন ছিল যে, এটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ওয়াজের মঞ্চেও জায়গা করে নেয়। এই ভিডিও নিয়ে ওয়াজ করেন জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা গিয়াসউদ্দিন তাহেরি। যদিও ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো এই ভিডিও নিয়ে অনুসন্ধানে এর কোনো সত্যতা পায়নি। একটি ভিত্তিহীন তথ্যকে বিভিন্ন সময়ে ধারণকৃত ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার একাধিক ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে।

ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাংলাদেশি হেনস্তার শিকার

ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের হার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকদের উদ্যাপন করতে দেখা যায়। এই উদ্যাপনের প্রতিক্রিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। এই উত্তেজনার মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা নিতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তবে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওটি ভারতীয়রাই ট্রলের উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন।

নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও

২০২৩ সালের শেষদিকে এসে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলতি বছর থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষক প্রশিক্ষণের ভিডিও দাবি করে একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিও নিয়ে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগসহ দেশের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। এসব ভিডিও নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওগুলোর সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ভারতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও প্রচার করে নতুন শিক্ষাক্রমের ভিডিও দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে।

এই বছরের শেষে আমরা নতুন আশা ও সম্ভাবনার সাথে ২০২৪ সালকে বরণ করতে যাচ্ছি। নতুন বছরে আমাদের সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ অপেক্ষা করছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাই।

সূত্র: আজকের পত্রিকা