বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের হঠাৎ উল্লম্ফন যেন এক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজের দাম ঘিরে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা জনসাধারণের জন্য নতুন করে এক দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছে। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে ২৫ টাকার পেঁয়াজ ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে—মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
প্রশ্ন উঠছে, এই অস্বাভাবিক দামের পেছনে কি কেবল আমদানির ঘাটতি, নাকি চলছে কোনো সুপরিকল্পিত চক্রান্ত? যুগান্তরের অনুসন্ধান বলছে—দায়ী একটি সংঘবদ্ধ মজুতদার চক্র, যারা ‘ভারতীয় পেঁয়াজ সংকট’-এর সুযোগ নিয়ে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
দুই সপ্তাহে দ্বিগুণ হলো পেঁয়াজের দাম
মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে—যা বাজারে আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। খুলনার তেরখাদা উপজেলার কাটেংগা বাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে ১৪ দিন আগেও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হতো ২৫ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে, সেখানে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোতেও এই মূল্যবৃদ্ধির ছোঁয়া স্পষ্ট। কাওরান বাজার, শ্যামবাজারসহ বড় বড় আড়তে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও সেই একই পেঁয়াজের পাইকারি দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এই হঠাৎ উর্ধ্বগতির পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির অভিযোগ করছেন অনেকেই।
১ কেজি পেঁয়াজের দাম কত এখন?
বর্তমানে রাজধানীর মালিবাগ, কাওরান বাজার, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও, রমজান এবং ঈদের সময়ে এই পেঁয়াজই বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। অর্থাৎ দুই সপ্তাহে দামের পার্থক্য প্রায় দ্বিগুণ।
এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। যাদের মাসিক আয় সীমিত, তাদের জন্য রান্নার অন্যতম প্রধান উপাদান পেঁয়াজ এখন বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে অল্প করে কিনছেন কিংবা পুরোপুরি বাদ দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ফেসবুক স্টোরি থেকে আয়ের সুযোগ: কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুখবর, পারবনে আপনিও
আজকের পেঁয়াজের দাম কত?
দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী। ২০ এপ্রিল শনিবার, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে এই দাম কিছুটা কম হলেও তাতেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
আরও পড়ুন
পাইকারি বাজার সূত্রে জানা গেছে, সেখানে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নিচ্ছেন, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে ভোক্তাদের ওপর।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ছে?
এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হ্রাস পাওয়ায় দেশের বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। চলতি মৌসুমে আমদানির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই কম, যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে খুচরা ও পাইকারি বাজারে।
তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও উদ্বেগজনক তথ্য। বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একাধিক সিন্ডিকেট গোপনে পেঁয়াজ মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। মৌসুমে দেশীয় উৎপাদন ভালো হলেও বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমিয়ে ফেলার পেছনে এই গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভরা মৌসুমেও মজুতের খেলা
দেশে এখনো পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হয়নি। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত মাঠ থেকে পেঁয়াজ উত্তোলন চলে। কিন্তু এর মধ্যেই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্র কৌশলে ভরা মৌসুমের দেশি পেঁয়াজ মজুত করে রেখেছে। এরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পেঁয়াজ কিনে বাজারে না ছেড়ে গুদামে তুলে রাখছে।
ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানিতে ছন্দপতন
ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কিছুটা কমে যাওয়াও বাজার অস্থিরতার আরেকটি কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো, দেশেই যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, তা দিয়ে চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমদানি সাময়িক কমলেও এত বড় মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক নয়।
সিন্ডিকেটের নেপথ্যে কারা?
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, একাধিক ব্যবসায়ী চক্র এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে চাপে ফেলতে চাচ্ছে। তারা একটি বার্তা দিতে চাচ্ছে যে, ভারতীয় পেঁয়াজ ছাড়া দেশের বাজার চলতে পারে না। এইভাবে সরকারবিরোধী অবস্থান তৈরি করার পাঁয়তারা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাইকারি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, “এটা এক ধরনের কারসাজি। ঈদের পর থেকেই কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী গুদামজাত শুরু করেছে।”
আজকের পেঁয়াজের দাম কত – খুচরা বাজারে ভয়াবহ বাস্তবতা
রাজধানীর খুচরা বাজারে একাধিক ক্রেতা বলছেন, ৩০-৩৫ টাকার পেঁয়াজ এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। মালিবাগের এক ক্রেতা বলেন, “ঈদের সময় একটা স্বস্তি ছিল। কিন্তু এখন তো আবার সব আগুন হয়ে গেছে। পেঁয়াজের দাম এমন কেন? সরকার কিছু করছে না?”
বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কত – ক্রমেই বাড়ছে আক্ষেপ
ঢাকার বাইরের বাজারে যেমন ময়মনসিংহ, খুলনা, বগুড়া, সিলেটেও একই চিত্র। প্রতিটি বাজারেই আজকের পেঁয়াজের দাম খুচরা পর্যায়ে ৬০-৭০ টাকা। কোথাও কোথাও ৭৫ টাকাও ছুঁয়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা উভয়ই চরম বিপাকে।
ভোক্তার অধিকারে হস্তক্ষেপ
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় নেতা এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “এই বাজার অস্থিরতা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। সরকারের উচিত কঠোর নজরদারি এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।”
সরকার কি করছে?
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাজারে কারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে, তা খুঁজে বের করতে তিন স্তরের তদন্ত চালানো হবে।
কী করা উচিত এখন?
১. পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদনকারীদের উৎসাহিত করা। ২. বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে মজুত নিয়ন্ত্রণে কঠোর অভিযান। ৩. সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। ৪. অন্তর্বর্তী সরকার রমজানে যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, তা সারা বছর ধরে রাখতে হবে।
এই মুহূর্তে ‘পেঁয়াজের দাম’ দেশের অন্যতম আলোচিত বিষয়। ১ কেজি পেঁয়াজের দাম কত, আজকের পেঁয়াজের দাম কত, বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কত—এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিনকার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বাজারে নিয়মিত নজরদারি এবং সিন্ডিকেটবিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে, এবং তা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
1 thought on “পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ- অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো ‘ভয়ংকর’ তথ্য”