একসময় মানুষ ভাবত, মোবাইল দিয়ে শুধু কথা বলা যায়। এখন মানুষ বিশ্বাস করে—মোবাইল দিয়ে পুরো জীবন চলে। আর এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে একটি নাম—বিকাশ।
২০২৪ সালটি এই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা (MFS) জায়ান্টের জন্য এক ঐতিহাসিক বছর হয়ে উঠেছে। যখন পুরো বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন আর ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন বাংলাদেশে বিকাশ হয়ে উঠেছে সেই যাত্রার প্রধান চালক।
আরো পড়ুন: বিকাশ খবর জানলে আপনি থাকবেন সবার এক ধাপ এগিয়ে
২০২৪: একটি সোনালী বছর
২০২৪ সালে বিকাশ রেকর্ড ৩১৬ কোটি টাকার নিট মুনাফা করেছে—এই প্রথম প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ৩০০ কোটির ঘর ছুঁয়েছে। শুধু মুনাফাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,০৫৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৮৬৭ কোটি বেশি—প্রায় ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
এই সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিবেদন নয়, এগুলো হলো আস্থা, প্রযুক্তি এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের প্রতিচ্ছবি।
১০ বছরে আয় ৯ গুণ, মুনাফা ১৭ গুণ!
২০১৪ সালে যেখানে বিকাশের মোট আয় ছিল মাত্র ৫৭৩ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকায়—অর্থাৎ ৯ গুণ বৃদ্ধি। মুনাফার দিক থেকে প্রবৃদ্ধি আরও চমকপ্রদ—২০১৪ সালে যেখানে মুনাফা ছিল ১৯ কোটি টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি টাকায়—প্রায় ১৭ গুণ!
এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের বলে দেয়, বিকাশ কেবলমাত্র একটি লেনদেন প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি একটি ডিজিটাল আর্থিক বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র।
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
লোকসান থেকে লাভের রাজপথ
তবে এই সাফল্যের গল্প এতটা মসৃণ ছিল না।
২০১৮ থেকে ২০২১ সাল—এই সময়টা ছিল বিকাশের জন্য চ্যালেঞ্জের অধ্যায়। ২০২১ সালেও তারা ১১৭ কোটি টাকা লোকসান করেছিল। কিন্তু সেই সঙ্কট জয় করে ২০২২ সালে লাভ করে ১৮ কোটি টাকা, ২০২৩-এ ৯৯ কোটি টাকা, এবং ২০২৪-এ এক লাফে ৩১৬ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, সঠিক কৌশল, প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যতদৃষ্টি থাকলে যে কোনো প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াতে পারে।


দেশের সবচেয়ে বড় এমএফএস প্ল্যাটফর্ম
আজ বিকাশ মানেই ডিজিটাল লেনদেনের প্রতীক।
- গ্রাহক সংখ্যা: প্রায় ৮ কোটি
- এজেন্ট সংখ্যা: ৩.৩ লাখ
- মার্চেন্ট পয়েন্ট: ৫.৫ লাখের বেশি
দেশের প্রতিটি প্রান্তে বিকাশ এখন শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়—গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, ন্যানো ঋণ গ্রহণ, সঞ্চয়—সব কিছুর এক ডিজিটাল সমাধান।
আরো পড়ুন: অনলাইন ইনকাম এবার হবেই: রইলো ১০ উপায়, লাগবেনা অভিজ্ঞতা
সিএফও-এর ব্যাখ্যা: “দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই সাফল্যের চাবিকাঠি”
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিকাশের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মঈনুদ্দিন মোহাম্মদ রাহগীর বলেন, “বিকাশ সব সময়ই টেকসই প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছে। স্বল্পমেয়াদি মুনাফার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তি-ভিত্তিক অগ্রগতি আমাদের মূল লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, “ক্যাশলেস বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আমরা এক দশক ধরে বিনিয়োগ করেছি প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং মানুষের ডিজিটাল সক্ষমতায়। সেই কৌশল আজ ফল দিচ্ছে।”
বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও সচেতনতার সমন্বয়
বিকাশের টিকে থাকার মূল শক্তি তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে:
- প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ: অ্যাপ, সাইবার সিকিউরিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে নিয়মিত উন্নয়ন।
- অবকাঠামো সম্প্রসারণ: গ্রামে-গঞ্জে বিকাশ এজেন্টদের উপস্থিতি।
- ডিজিটাল শিক্ষায় জোর: গ্রাহক এবং মার্চেন্টদের সচেতনতা বাড়ানো।
এই তিনটি কাজের ফলেই বিকাশ দেশের ফিনটেক ইকোসিস্টেমে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে।
কে কে আছেন বিকাশের পেছনে?
বিকাশের অংশীদার তালিকা খুবই চমকপ্রদ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ:
- ব্র্যাক ব্যাংক (মূল অংশীদার)
- মানি ইন মোশন (যুক্তরাষ্ট্র)
- আইএফসি (বিশ্বব্যাংক গ্রুপ)
- বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন
- অ্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (আলিবাবা গ্রুপ)
- সফটব্যাংক (জাপান)
এই বৈশ্বিক বিনিয়োগের পেছনে আস্থা রয়েছে বিকাশের কর্মপরিকল্পনা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার ওপর।
আরও পড়ুন: ফেসবুক স্টোরি থেকে আয়ের সুযোগ: কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুখবর, পারবনে আপনিও


সরকার ও ব্যাংকের আয়ের সঙ্গী
২০২৪ সালে বিকাশ:
- সরকারকে কর দিয়েছে: ১৮৯ কোটি টাকা
- ব্যাংক থেকে সুদ আয় করেছে: ১৯০ কোটি টাকা
সরকারি রাজস্বে অবদান রাখা এবং নিজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনার দক্ষতাই বিকাশকে অন্যদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রেখেছে।
পরিসংখ্যান বলছে যা:
বছর | আয় (কোটি টাকা) | মুনাফা/লোকসান |
---|---|---|
২০১৪ | ৫৭৩ | ১৯ কোটি (মুনাফা) |
২০১৮ | ~৩৪০০ | হ্রাস পায় মুনাফা |
২০২১ | ~৪২০০ | ১১৭ কোটি (লোকসান) |
২০২৩ | ৪১৯১ | ৯৯ কোটি (মুনাফা) |
২০২৪ | ৫০৫৮ | ৩১৬ কোটি (মুনাফা) |
কেন এই সাফল্য?
✔️ গ্রাহক বিশ্বাস
✔️ প্রযুক্তিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ
✔️ সারাদেশব্যাপী নেটওয়ার্ক
✔️ কম খরচে বেশি সুবিধা
✔️ ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের সঙ্গে মিল
ভবিষ্যতের পথে বিকাশ
বিকাশ থেমে নেই।
নতুন পরিকল্পনায় রয়েছে:
- আইএমপিএস (ইনস্ট্যান্ট মানি পেমেন্ট সার্ভিস)
- ক্রস-বর্ডার রেমিট্যান্স সহজীকরণ
- ডিজিটাল লোন স্কোরিং প্রযুক্তি
- ডিপোজিট প্রোগ্রাম আরও সম্প্রসারণ
বিকাশ চায়, প্রতিটি বাংলাদেশি যেন সহজে, নিরাপদে এবং দ্রুত আর্থিক সেবা নিতে পারে—মোবাইলের একটি ক্লিকে।
আরো পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম বিকাশে পেমেন্ট – কোনো ইনভেস্ট ছাড়াই ঘরে বসে আয় শুরু করুন!
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুখ
বিকাশ এখন শুধু দেশীয় প্ল্যাটফর্ম নয়—একটি গ্লোবাল কেস স্টাডি।
বিশ্বের বড় বড় ফিনটেক সম্মেলনগুলোতে বিকাশের সাফল্য উপস্থাপন করা হচ্ছে উদাহরণ হিসেবে। “কীভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ মোবাইল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে পারে”—এই প্রশ্নের উত্তর এখন বিকাশ।
শেষ কথা: বিকাশ শুধু নাম নয়, একটি সম্ভাবনার প্রতীক
১০ বছর আগে যে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিল একটিমাত্র লক্ষ্য নিয়ে—দেশের মানুষকে দ্রুত ও সহজ উপায়ে টাকা পাঠানোর সুবিধা দেওয়া, আজ সেটি হয়ে উঠেছে একটি অর্থনৈতিক রূপান্তরের মূল চালক।
২০২৪ সালের রেকর্ড আয় ও মুনাফা শুধু ব্যবসায়িক সফলতা নয়—এটি একটি দেশের ডিজিটাল যাত্রার, স্বপ্নের ও বাস্তবায়নের গল্প।
বিকাশ দেখিয়েছে, বাংলাদেশও পারে।
আপনি কি বিকাশের এই উত্থানকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যতের ইঙ্গিত মনে করেন? আপনার মতামত নিচে জানান।