➡️ বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ: ইরানের হরমুজ প্রণালী বন্ধের সিদ্ধান্তে তেল ও শেয়ারবাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বলা হয় যে সামুদ্রিক পথটিকে, সেই হরমুজ প্রণালী এখন আগুনের সীমানা। ইরান সরকার রোববার তাদের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে জানিয়েছে, তারা এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন শুধু বাকি রয়েছে সুপ্রিম কাউন্সিলের চূড়ান্ত অনুমোদন।
এই ঘোষণার পরই বিশ্ববাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তেলের দাম লাফিয়ে বেড়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে শুরু হয় বড় ধরনের ধস।
আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন .কাজ করা খুব সোজা
তেলের বাজারে আগুন: কয়েক ঘণ্টায়ই রেকর্ড বৃদ্ধি
হরমুজ প্রণালী বন্ধের আশঙ্কায় সোমবার সকালে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭.৩৬ ডলার প্রতি ব্যারেল, যেখানে WTI তেলের দাম পৌঁছায় ৭৪.১৫ ডলারে—যা গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব তেলের মোট ২০ শতাংশ প্রতিদিন হরমুজ প্রণালী হয়ে সরবরাহ হয়। অর্থাৎ, প্রতিদিন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের তেল এই জলপথের উপর নির্ভর করে। একে ঘিরে এমন উত্তেজনা যে, বাজারে ভয়ভীতির সঞ্চার ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ধ্বস: আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা
ইরানের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের S&P 500, NASDAQ এবং Dow Jones–এর মতো বড় সূচকগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ পতন দেখা যায়। বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিনিয়োগে ঝুঁকতে শুরু করেছে যেমন সোনা এবং সরকারি বন্ড।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি হরমুজ প্রণালী সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এটি শুধু জ্বালানির দাম নয়—পণ্য সরবরাহ, উৎপাদন খরচ, ভোক্তামূল্য সব কিছুর উপরই চাপ ফেলবে। এর চাপে ধসে পড়তে পারে বড় বড় অর্থনৈতিক কাঠামো।
আরো পড়ুন: অনলাইন ইনকাম এবার হবেই: রইলো ১০ উপায়, লাগবেনা অভিজ্ঞতা
আরও পড়ুন
হরমুজ প্রণালী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
হরমুজ প্রণালী, দৈর্ঘ্যে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার হলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথগুলোর একটি। প্রতিদিন এই পথ দিয়ে গড়ে ১৭–২০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি হয়।
এটি মূলত উপসাগরীয় দেশগুলো—সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার ও ইরানের—তেল রপ্তানির প্রধান রুট। আর এই রপ্তানি নির্ভরশীল বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো—চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর।
এই পথ একবার বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প রুটে যেতে সময়, অর্থ এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন জেগে ওঠে।
ইরান কীভাবে প্রণালী বন্ধ করতে পারে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের কাছে একাধিক সামরিক উপায় রয়েছে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার জন্য। যেমন:
- সামুদ্রিক খনির বিস্ফোরক বসানো
- ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো
- দ্রুতগামী আক্রমণাত্মক নৌকা দিয়ে বাধা সৃষ্টি করা
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর এবং আন্তর্জাতিক নৌজোট সবসময় এই অঞ্চলে সক্রিয় থাকে। তাই সম্পূর্ণভাবে প্রণালী বন্ধ রাখা ইরানের পক্ষেও বেশ চ্যালেঞ্জিং।
অতীতে কি হরমুজ প্রণালী কখনও বন্ধ হয়েছিল?
১৯৮০–৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে ইরান চেষ্টা করেছিল প্রণালীতে খনি পুঁতে চলাচলে বাধা দিতে। কিন্তু কখনোই পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি।
এক বড় কারণ হলো, এই পথ ইরানের নিজের তেল রপ্তানির জন্যও অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ, তারা নিজেও এই প্রণালী বন্ধ করলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
আরো পড়ুন: কিভাবে ফেসবুকে প্রতিদিন $500 আয় করা যায় – বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সহজ কৌশল
এবার পরিস্থিতি ভিন্ন কেন?
এবারের পরিস্থিতি আলাদা কারণ, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায়—ফোর্ডো, নাটাঞ্জ এবং ইসফাহান—হামলা চালিয়েছে।
এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান বলেছে, তারা এবার “উপযুক্ত জবাব” দেবে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার এমেইল কোসারি বলেন:
"আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের জবাবে সমস্ত সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।"
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এবার তারা কেবল হুমকি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া: চীন, ভারত এবং ইউরোপ উদ্বিগ্ন
চীন ও ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে সরাসরি তাদের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে “সংযম দেখানোর” আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, “চীন যেন ইরানকে এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখতে প্রভাব খাটায়।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নও জানিয়েছে, এই পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান না হলে তারা বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজতে বাধ্য হবে।
বিকল্প রুট কি আদৌ আছে?
তেলের জন্য বিকল্প রুট বলতে মূলত ইরান বাইপাস করা রুট বোঝায়। তবে এই রুটগুলো অনেক দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং নিরাপত্তাহীন। যেমন:
- সৌদি আরবের ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন
- ইয়েমেনের Aden বন্দরের মাধ্যমে কিছু সীমিত রুট
কিন্তু এগুলো সবই অস্থায়ী সমাধান। স্থায়ীভাবে হরমুজ প্রণালীর বিকল্প নেই।


ইরানের আর্থিক ক্ষতি কি হবে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে ইরান নিজেও তেলের রপ্তানি করতে পারবে না। এতে তাদের রিজার্ভ হ্রাস পাবে, মুদ্রার মান কমবে এবং ভেতরে বিদ্রোহ বাড়বে।
তবে ইরানের ভাবনা এখন ভিন্ন—তারা চাইছে সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রকে টেবিলে আনতে।
আরো পড়ুন: ফ্রি টাকা ইনকাম বিকাশে পেমেন্ট – কোনো ইনভেস্ট ছাড়াই ঘরে বসে আয় শুরু করুন!
ভবিষ্যতের চিত্র: অস্থিরতা আরও বাড়বে
বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে যা হতে পারে:
- জ্বালানির দাম আরও বাড়বে
- খাদ্য ও পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যাবে
- উন্নয়নশীল দেশগুলো বড় সংকটে পড়বে
- যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা যুদ্ধে রূপ নিতে পারে
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে—হরমুজ প্রণালী খুলে থাকবে নাকি নতুন এক তেলের যুদ্ধের সূচনা হবে?
শেষ কথা:
ইরানের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার ফল নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত চাল। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে শুধুমাত্র তেলের দাম নয়—খাদ্য, পরিবহন, ব্যবসা, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত প্রভাবিত হবে।
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সামুদ্রিক পথের ভবিষ্যৎ এখন একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতার ওপর নির্ভর করছে।
এই সংকট যদি সমাধান না হয়, তাহলে এটি হবে আধুনিক যুগের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বিপজ্জনক সামুদ্রিক সঙ্কটগুলোর একটি।
হরমুজ প্রণালী নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
❓ হরমুজ প্রণালি কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: হরমুজ প্রণালী মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের মাঝে অবস্থিত। এটি ইরান এবং ওমানের মধ্যে অবস্থিত একটি সরু সামুদ্রিক পথ, যার দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। এটি এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার জ্বালানি সরবরাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন।
❓ হরমুজ প্রণালী দিয়ে পৃথিবীর মোট তেলের কত অংশ যায়?
উত্তর: হরমুজ প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়, যা গড়ে ১৭–২০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল। অর্থাৎ, পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি তেল এই পথের উপর নির্ভরশীল।
❓ হরমুজ প্রণালী কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। উপসাগরীয় দেশগুলোর তেল ও গ্যাস রপ্তানির প্রধান রুট এটি। এখান দিয়ে না গেলে বিকল্প রুট ব্যয়বহুল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ। এই পথ বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম, সরবরাহ এবং অর্থনীতিতে তীব্র প্রভাব পড়ে।
❓ হরমুজ প্রণালী কি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ট্রানজিট চোকপয়েন্ট?
উত্তর: হ্যাঁ, হরমুজ প্রণালীকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ট্রানজিট চোকপয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। এখানে তেলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট এবং রসদও পরিবাহিত হয়। এই পথ বন্ধ হলে বিকল্প কোনো বড় চ্যানেল নেই—এই কারণেই এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।