রাজনৈতিক উপন্যাসের লিখে পল লিঞ্চের বুকার জয়

বুকার

• মোরশেদুল ইসলাম

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে ছুরিকাঘাতের হামলায় তিন শিশু আহত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই শহরজুড়ে শুরু হয় প্রচণ্ড বিক্ষোভ। পুলিশের তরফে বলা হয়, ‘কট্টর ডানপন্থী মতাদর্শ দ্বারা চালিত পুরো এক পাগলের দল’ এই হাঙ্গামার সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার কয়েকদিন পরেই ওই শহরের একজন ঔপন্যাসিক এমন একটি উপন্যাসের জন্য একটি সাহিত্য পুরস্কার জয় করেন যে বইয়ের উপজীব্য ঐ শহরেরই কাহিনি ঘিরে।

বলছি বুকার পুরস্কারের কথা। ইংরেজিভাষী দুনিয়ার অন্যতম প্রধান সাহিত্য পুরস্কার এটি। মর্যাদায় নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের পরপরই এর স্থান।

আইরিশ লেখক পল লিঞ্চ (৪৬) তাঁর [প্রফেট সং] উপন্যাসের জন্য এ বছর (২০২৩) বুকার পুরস্কার জিতেছেন। বইটি লিঞ্চের লেখা পঞ্চম বই এবং তিনি এটির পিছনে চার বছর ধরে কাজ করেছেন।

[প্রফেট সং] উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে অত্যাচারে নিমজ্জিত কল্পিত এক ডাবলিন শহরের পটভূমিতে। টোটালিটারিয়ানিজম বা একনায়কতন্ত্রবাদের দিকে ঝোঁকা সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গোপন পুলিশের সদস্যরা একদিন মাইক্রোবায়োলজিস্ট আইলিশের বাসায় আসে; তার স্বামী আয়ারল্যান্ডের শিক্ষক ইউনিয়নের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা; তারা তাঁকে চায়। শীঘ্রই অন্যান্য শত শত বেসামরিক লোকের সঙ্গে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। পিছনে রেখে যান শুধু আইলিশকে; তাদের চার সন্তান এবং তার বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনা করার জন্য। এভাবেই গৃহযুদ্ধের মধ্যে পরিবারটিকে একসঙ্গে রাখার জন্য লড়াই করে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আইলিশ। উপন্যাসজুড়ে পরিবারটির ভয়ঙ্কর এক নতুন দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই দেখানো হয়েছে যেখান থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করে।

ডাবলিন শহরে প্রায়শই এমন দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। শুধু ঐ কল্পিত ডাবলিন শহর নয়, ঘটনাপ্রবাহের বাস্তবতা ছাড়িয়ে গেছে দেশ-দেশান্তরে।  দুনিয়ার দেশে দেশে আজ একনায়কতন্ত্র, গৃহযুদ্ধ আর মানুষের দুর্দশা যেন এক অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবেরই বাস্তবতার ছায়ায়, কল্পনামিশ্রিত হয়ে ঘটনাগুলো আশ্চর্যজনকভাবে উঠে এসেছে [প্রফেট সং] উপন্যাসে।

পুরষ্কারের জন্য গঠিত বাছাই কমিটি এমন একটি উপন্যাস চেয়েছিল যা সমকালের কথা বলতে পারে এবং একইসঙ্গে সময়কে ছাড়িয়ে গিয়ে  দীর্ঘস্থায়ী টিকে থাকার সম্ভাবনাও রাখে। তারা বলেছেন: “এই অস্থির সময়ে, আমরা একটি পথনির্দেশক দৃষ্টিভঙ্গিসহ একটি উপন্যাসের সন্ধান করেছি – একটি বই যা আমাদের মনে করিয়ে দিবে যে আমরা আমাদের চেয়েও বেশি; আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিবে যা সংরক্ষণ করার যোগ্য। এবং সেদিক থেকে এটি একটি মর্মস্পর্শী এবং সত্য উপন্যাস যেখানে আমাদের সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্বেগগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

বিশিষ্ট সাহিত্যবোদ্ধা এইমি ওয়ালশ লিখেছেন, ‘লিঞ্চের কল্পিত আয়ারল্যান্ড তাবৎ দুনিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে শরণার্থীরা স্থলের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে সমুদ্রে যায়। [প্রফেট সং] ফিলিস্তিন, ইউক্রেন এবং সিরিয়ার সহিংসতার প্রতিফলন করে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে পালিয়ে আসা সকলের অভিজ্ঞতাও প্রতিফলিত করে।’

লিঞ্চ নিজেও বলেন, ‘[প্রফেট সং] সিরিয়ার যুদ্ধ এবং শরণার্থী সংকট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন তিনি। ‘এখানে একটি সতর্কবাণী আছে’- বিশেষ করে এ কথা বলার জন্য আমি বইটি লিখিনি, আমি বইটি লিখেছি একটি বার্তা দেওয়ার জন্য যে এই বইটিতে যা ঘটছে তা যুগ যুগ ধরে ঘটছে; এবং সম্ভবত এই ধরনের ধারণার প্রতি আমাদের নিজেদের প্রতিক্রিয়া আরও জোরালো করতে হবে।’ যদিও তার মতে তিনি স্পষ্টভাবে কোনো রাজনৈতিক ঔপন্যাসিক নন।

পল লিঞ্চ ১৯৭৭ সালে আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কাউন্টি ডোনেগালে বেড়ে ওঠেন এবং এখন থাকেন ডাবলিনে। একসময় তিনি পরিচিত ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে। সাহিত্য জগতে পা রাখেন ২০১৩ সালে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলো হলো [বিয়ন্ড দ্য সি], [গ্রেস], [দ্য ব্ল্যাক স্নো] এবং [রেড স্কাই ইন মর্নিং]। তিনি আইরিস মারডক, জন ব্যানভিল, রডি ডয়েল এবং অ্যান এনরাইট-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বুকার পুরস্কার জেতা পঞ্চম আইরিশ লেখক।

প্রসঙ্গত, এই নিয়ে টানা দুই বছর রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে লেখা উপন্যাস বুকার পুরস্কার জিতেছে। ২০২২ সালে শেহান করুণাতিলাকা [দ্যা সেভেন মুন অব মালি আলমেদা]’র জন্য জিতেছিলেন। বইটি শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা হয়েছিল।
..……………….

(বিবিসি ও গার্ডিয়ান অবলম্বনে।)