কাঁটাতার

কাঁটাতার

–মোরশেদুল ইসলাম

সেপ্টেম্বরের রাত। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের চাপে চ্যাপটা হয়ে যায় কালো কালো রাত। ফজরের আজানেরও আগে কয়েকটা ফিঙের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে আবদুল হকের। পাশের ঘরে শুয়ে আছে বিরু খ্যান ও তার নাতি। দরজার কাছে গিয়ে ‘দাদা, দাদা, ওঠো গো’ বলতেই বিরু খ্যান কাশতে কাশতে আবদুল হককে জবাব দেয়, ‘মোর তো নিন্দে ধরে নাই রে সারা রাইত, উঠিম্ আর কী!’ নাতি সৌম্য খ্যান ঘুমাচ্ছে দেদার। কিন্তু বাড়িতে ফিরে যেতে হবে, ভারতে ফিরে যেতে হবে, সকালে ট্রেন ধরতে হবে, অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা করতে হবে… ইত্যাদি চিন্তায় রাতভর তেমন ঘুমাতে পারেনি বিরু খ্যান। এসব তো স্বাভাবিক নিয়মের ব্যাপার। কেবল এসব চিন্তাই কি ঘুমাতে দেয়নি বিরু খ্যানকে? না, আরও কিছু ব্যাপার রয়েছে, যেগুলো সময়ের অদৃশ্য আস্তরণে ঢেকে গেছে আজ। প্রায় সবার কাছেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেগুলোই আজ বিদায়বেলায়, ভারতে ফিরে যাওয়ার ক্ষণে ঘুমাতে দেয়নি তাকে।

ইজিবাইকে করে উলিপুর থেকে লালমনিরহাটে যেতে ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার। লালমনিরহাট থেকে সকাল নয়টায় বুড়িমারীর উদ্দেশে একটা ট্রেন ছাড়ে। করতোয়া এক্সপ্রেস। সেই ট্রেন ধরে তারা পৌঁছে যায় বুড়িমারীতে। চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ঢুকবে ভারত ভূমিতে।

দিনমজুর বন্ধু আবদুল হক তাদের সঙ্গেই এসেছে। বন্দর পর্যন্ত। বিরু খ্যানকে বিদায় জানানোর জন্য। বন্দরের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে বিদায়ের সময় বিরু খ্যান ও আবদুল হক উভয়েরই চোখে পানি। একে অপরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেন এটাই শেষ বিদায়! যেন আর কখনোই দেখা হবে না কারও!

বন্দরের বাংলাদেশ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আবদুল হক তাকিয়ে আছে স্থির নয়নে। বিরু খ্যানও বারবার পিছু ফিরে তাকায়। তারা কেউ কারও আপনজন নয়, কেবল প্রতিবেশী। তবু যেন আপনার চেয়ে বেশি। এক শক্তিশালী অদৃশ্য সম্পর্ক ঠিক আকাশ আর মাটির মতো টিকে আছে তাদের মধ্যে।

১৯৮০-এর দশকের কথা। বিরু খ্যান তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায়। তার পর থেকে দুই-চার বছর পরপর বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করে। তখন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। ৯০ দশকের শেষ দিকে ভারত তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয় ও ভীষণ কড়াকড়ি আরোপ করে। মন চাইলেও খুব সহজে বাংলাদেশে আসতে পারা যায় না। তবু পাঁচ-সাত বছর পরপর আসে সে। পেছনে ফেলে যাওয়া জন্মস্থান, সহায়-সম্পত্তি, ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির, বিশাল পুকুর, অসংখ্য বন্ধুবান্ধব, চিরচেনা পরিবেশ-প্রতিবেশ সবকিছুর জন্যই স্মৃতিকাতর তার মন। কবরের মতো মাটিচাপা দিয়ে রাখা আরও কিছু বিষয় টানে তাকে। প্রবলভাবে টানে। কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে না। পারে কেবল এক আবদুল হকের কাছে। সেই আবদুল হককে হয়তো চিরদিনের জন্য বিদায় জানাল আজ। বয়স সত্তর পেরিয়েছে বিরু খ্যানের। শরীর আর সায় দেয় না আগের মতো। তাই মনটা এবার বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে সবকিছু আধা মাঙনা দরে বিক্রি করে দিয়ে ভারতে গিয়েছিল তারা। একরকম তড়িঘড়ি করেই। এলাকার লোকজন এভাবে তড়িঘড়ি করে তাদের দেশ ছাড়ার কারণটা একটু-আধটু আঁচ করতে পারলেও পুরো ঘটনা তেমন কেউই জানত না। জানত শুধু আবদুল হকদের পরিবার। পরে অনেকের কাছেই হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে আসল ঘটনা।

সীমান্তের কাঁটাতার ছাড়া বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার আরও কিছু কারণ আছে। বিরু খ্যানরা ভারতে গিয়ে প্রথমে দিনহাটায় কিছু জমিজিরাত কিনে বসতি গেড়েছিল। তার অন্য দুই ভাই ততটা শিক্ষিত না হলেও তিনি তখনকার দিনে বিএ পাস ছিলেন। কোচবিহারের দিনহাটা এলাকা তখন প্রত্যন্ত গ্রামের মতো অনুন্নত। শিক্ষিত বিরু খ্যানের মন টেকেনি সেখানে। ছেলেমেয়েদের ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানোর চিন্তাও ছিল। তিনি তখন সেখানকার তার ভাগের জমিজিরাত আবারও আধা মাঙনা দরে বিক্রি করে স্থানান্তরিত হন শিলিগুড়িতে। সেখানে নৌকাঘাট এলাকায় সামান্য জমি কিনে কোনোমতে একটা বসতি গড়েন। বাংলাদেশের এককালের বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক বিরু খ্যান এখন মোটামুটি নিঃস্বপ্রায়। মেয়েটার ক্যানসার হয়েছিল। তার চিকিৎসা বাবদ বহু অর্থ খরচ হয়ে যায়। তাকে বাঁচানো যায়নি শেষ তক। আর ছেলেটা পড়াশোনা করলেও তেমন ভালো করতে না পারায় বাবার কাপড়ের ব্যবসায় লেগে আছে এখন।

বৃদ্ধ বিরু খ্যানের বাড়ির অদূরেই বয়ে চলে মহানন্দা নদী। একদম নীরবে। পানি ভরাট মহানন্দার তীরে এসে মাঝে মধ্যেই বসে থাকেন তিনি। একা একা। ভাটিমুখী স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে তার মনও ছোটে বাংলাদেশে। বিক্রি করে আসা ঘর-বাড়ি, পুকুর, মন্দির কিংবা আরও অনেক কিছুর সঙ্গে দেখা করে আসেন। মহানন্দার মতো নীরবে। মনে মনে।

বন্দরে ঠাকুরদার ও আবদুল হকের বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার দৃশ্য দেখে নাতি সৌম্য খ্যানও একটু মনমরা হয়ে যায়। কিছুটা বিব্রতও হয় এই ভেবে যে একজন মুসলিমের জন্য কেন ঠাকুরদার এত কান্না! সেই বিব্রতবোধ থেকেই তার মনে কিছু প্রশ্ন খেলে। বন্দরস্থলে সেপ্টেম্বরের চকচকে আকাশের ঝকঝকে রোদ। সেই রৌদ্রপোড়া মনে সে খণ্ড খণ্ড অনেক ঘটনার আগা-মাথা খোঁজার চেষ্টা করে।

অনার্স পড়ুয়া সৌম্যর বোধ হয়েছে থেকে সে দেখে এসেছে যখনই ঠাকুরদা বাংলাদেশে যেতে চায় ঠাকুরমা প্রচণ্ড বাদ সাধে। তবু মহানন্দার পানির মতো সব বাঁধা পেড়িয়ে ঠাকুরদা চলে যান বাংলাদেশে। নীরবে। বাড়িতে ফিরে আসার পর অনেক দিন যাবৎ কোনো একটা বিষয়ে খোঁটা দিতে থাকেন ঠাকুরমা। বিষয়টা উল্লেখ করেন না। তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এবারও ঠাকুরমা বাদ সেধেছিলেন। ‘এই শরীর নিয়েও বাংলাদেশে যেতেই হবে তোমার?!’ ঠাকুরমাকে ‘শেষ জীবনে পৌঁছেছি, আর কোনো দিন যেতে পারব কি না…’ ইত্যাদি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ঠাকুরদা। ‘আয়, আমার জন্মস্থানটা অন্তত একবার দেখে আয়, চল। আমি আর কদিন বাঁচব, চল আমার সঙ্গে।’ সঙ্গে ঠাকুরমাও বলল। তাই ইচ্ছে না থাকলেও ঠাকুরদার সঙ্গে বাংলাদেশে তার আসা। এ যুগের ছেলেপেলেরা অতি আধুনিকতার কারণে পূর্বপুরুষের জন্মস্থানের প্রতি ততটা আকর্ষণ বোধ করে না বোধ হয়।

বাংলাদেশে যে ১০-১২ দিন থেকেছে তারা, আবদুল হকের বাড়ি ছাড়াও দু-তিনজন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। কোথাও কিছু বুঝতে পারেনি সৌম্য। আবদুল হকের কিছু কথা সে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে মনে মনে। আর ঠাকুরদাকে তো জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। তিনি কি আর তার অতীতের চাপা রাখা কাহিনি বলবে নাতিকে? তবু নাতি ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে, বিভিন্ন ঘটনা মিলিয়ে উদঘাটন করার চেষ্টা করে কেন বাংলাদেশের প্রতি ঠাকুরদার এখনো এত টান, এত মায়া!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় টগবগে তরুণ বিরু খ্যান। তার অন্য ভাইয়েরা যুদ্ধে না গেলেও প্রতিবেশী আবদুল হকের বড় ভাইদের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধোত্তর দেশে তার পড়াশোনার সাময়িক ব্যাঘাত ঘটলেও ঠিকই বিএ পাস করে। বড়লোকের সন্তান হওয়ায় চাকরির প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না তার। বাবা-মায়েরও আগ্রহ ছিল না। ‘হামার এত কিছু থাকতে তোক চাকরি করা লাগবে ক্যা, বাপ?’ ‘…করি, বসি থাকি আর কী করোং…’ এই বলে ৭০ দশকের শেষ দিকে আরডিআরএস নামের একটা এনজিওতে যোগ দেয় বিরু খ্যান। এই ঘটনার পরপরই তার বাড়ির লোকজন বুঝতে পারে আসল ঘটনা।

নাম তার খুশি। প্রতিবেশী এক মেয়ে। সুন্দরী, সহজ-সরল সেই মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী। আবিষ্কৃত হলো খুশির সঙ্গে বিরু খ্যানের হৃদয় ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার। মহাসমারোহে চলমান। বিরুর সব সময়ের সঙ্গী আবদুল হক তার ঘটক। আবদুল হক বয়সে বিরুর অনেক ছোট হলেও বন্ধুর মতোই খাতির। এলাকায় বিরুর সমস্ত কাজ-কর্ম, অপকর্ম, সুকর্ম, সবকিছুরই দোসর আবদুল হক।

আশ্বিনের এক গুমোট সন্ধ্যাবেলা। দপ্তর থেকে ফিরে বিরু হাওয়া খাচ্ছে পুকুরপাড়ে। সঙ্গে আবদুল হক। পশ্চিম আকাশে গোলাপের পাপড়ির মতো লেগে আছে গোধূলি। স্নিগ্ধতা গ্রাস করে আঁধার। ধীরে ধীরে সেই আঁধারে ডুবে যায় তাবৎ দুনিয়া। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ তখনো ওঠেনি। উঠবে শিগগিরই। সেই বিলম্বিত চাঁদের আগমনের প্রতীক্ষায় বিরহের গান ধরেছে ঝিঁঝিসহ নানা কীটপতঙ্গ। হঠাৎই বাড়ির ভেতরে বিরুকে তলব করে মা। বাবা দম ধরে ভীষণ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কিছুটা বকাঝকা করা হলো। বাকিটা বোঝানো হলো। মা-বাবার প্রত্যাশা বিরু নিশ্চয় দূরে থাকবে সেই মুসলিম মেয়ে খুশির থেকে। আবদুল হককেও শাসালেন, যেন সে দলালি না করে আর।

বিরু খ্যানদের বাড়ির পূর্ব দিকে, মাইল তিনেক দূরে ব্রহ্মপুত্র নদ। বাঁধভাঙ্গা স্রোত নদের বুকে। সেই স্রোত ভেঙে ডিঙি নৌকা বেয়ে ব্রহ্মপুত্রের চরে বেড়াতে গিয়েছে তারা। নৌকার মাঝি সেজেছে আবদুল হক। নির্জন চর আলতো, সাদা সাদা কাশফুলে ভরে গেছে। সেই চরে অভিসার শেষে নৌকায় ওঠার আগে ঢোঁরা সাপের কামড় খায় খুশি। সেই ঘটনা সামলাতে গিয়ে প্রথমে ওঝা, তারপর একজন-দুজন করে খবর পৌঁছে যায় বাড়িতে।

বিশাল সহায়-সম্পত্তির কারণে বিরুর বাবা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, এটা মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রাম। তাই শঙ্কিত তিনি। শঙ্কা কোনো আঘাত-আক্রমণের নয়। তেমন সাহস কিংবা মানসিকতা করারও নেই গ্রামে। শঙ্কা ছেলের ধর্মান্তরিত হওয়ার। শঙ্কা নিজের ‘জাত’ যাওয়ার। তাই আর কালক্ষেপণ না করে, তেমন চায়-চিন্তা না করেই বিয়ে দিয়ে দেন বিরু খ্যানের।

ভীষণ চাপে পড়েই, বাধ্য হয়ে বিয়ে করে ফেলে বিরু। খুশির কথা কি সে একবারও ভাবেনি? এরকমই একটা বাক্য লেখা চিরকুট আবদুল হকের মাধ্যমে হাতে আসে বিরুর। খুশি এখন শোকার্ত। একটা উথালপাতাল প্রেমকে কবর দিয়ে বউ নিয়ে সুখে থাকা হয় না বিরুর। চিঠি যায় খুশির কাছে, ‘ধৈর্য ধরো। আমি কবর দিইনি তোমার প্রেমকে।’ জবাবে ‘আর কিসের ধৈর্য ধরব?’ বলে প্রশ্ন করে খুশি।

প্রশ্ন সেখানেই। বিয়ে তো করেই ফেলেছে বিরু। আর কিসের জন্য ধৈর্য ধরতে হবে খুশিকে? বিরুকে ভুলে যাওয়ার জন্য? তা-ই যদি হতো, তবু তো ভালো ছিল। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হলো ঘটনার প্রলম্বিত ও ভিন্ন এক বাঁকের জন্য। যে বাঁকের মোহনায় মানুষ কেবল মরে যায়। টেনেটুনে দেহ বেঁচে থাকলেও তা পঙ্গুত্বেরই নামান্তর মাত্র।

সীমান্ত পেরিয়ে মেখলিগঞ্জ বাইপাসে এসে বাস ধরে বিরু খ্যান ও নাতি সৌম্য। বাস চলছে তার গতিতে। সেপ্টেম্বরের সূর্য যেন বাসের ঠিক ছাদের ওপরে বসে আছে। সব যাত্রীর মতো বৃদ্ধ বিরু খ্যানের দেহ থেকেও ঘাম ঝরে। কিন্তু মুখে কোনো কথা সরে না। তার দৃষ্টি বাইরে, সবুজ ধানখেতের দিকে প্রসারিত। একটার পর একটা ধানখেত কত দ্রুত দৃষ্টি থেকে নাই হয়ে যায়! পাতলা পাতলা বাড়িঘর ‘নাই’ হয়। বাস চলে। সময় চলে। চলে জীবনও। তবু কোথায় যেন কী থমকে আছে!…কত কিছু আনমনে ভেবে চলে বিরু খ্যান। ‘কী ভাবছ এত?’ সহসা সৌম্যর প্রশ্নে ভাবনার ঘোর ভাঙে তার। ‘না, কী আর ভাবব…দেখতে দেখতে জীবনসায়াহ্নে চলে এসেছি! তবু ভাবনা জাগে মাঝেমধ্যে, বাংলাদেশে থাকলে আজ হয়তো এই বাসে জার্নি করতে হতো না আমাদের!’ ‘এখনো এগুলো ভাবো তুমি?’ সৌম্য ঠাকুরদাদাদের হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ অতীতের কষ্টবোধ থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করে। নানা কিছু বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে তারও বাংলাদেশে এসে কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেছে মন।

আরও পড়ুন: সড়ক দুর্ঘটনা

সৌম্যর মনে পড়ে, আবদুল হকের সঙ্গে একদিন বিকেলে স্থানীয় বাজারে ঘুরতে বেড়িয়েছিল যখন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি সৌম্যর পরিচয় পেয়ে হাল-হকিকত জিজ্ঞেস করছিল। সৌম্যর বাবা ভারতে কাপড়ের ব্যবসা করে জানতে পেরে কেমন আক্ষেপের সুরে স্বগতোক্তি করছিল, ‘শালা বিরু রে বিরু! আজ দেশান্তরী না হইলে কত কিছু কইরব্যার পালু হয়…মুক্তিযোদ্ধা আছিল শালায়, এই ব্যাটা, এই নাতিরা আইজ বড় বড় অফিসার হইলো হয় দ্যাশোত!…শালা আসলে একটা কম্বক্তা!…’ পরে সৌম্য আবদুল হকের কাছে জানতে পেরেছিল ওই বৃদ্ধ তার ঠাকুরদার জিগরি দোস্ত ছিল। তাই অমন করে কথা বলছিল। এমনই অনেক কিছুর কথা, বিশাল বাড়ি, জমিজিরাতের কথা তারও মনে উঁকি দেয় মাঝেমধ্যে। সব এবার স্বচক্ষে দেখেছে সৌম্য। এখনো তার ঠাকুরদাদাদের সেই বিশাল বাড়ি, শানবাঁধানো পুকুর টিকে আছে। একটু-আধটু বদল এসেছে সবকিছুতে যদিও। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। তবু এই দীর্ঘশ্বাস, এই বিষাদ….আসল বিষাদের প্রশ্ন থেকে তার মনোযোগ সরাতে পারে না! সে আবদুল হকের কাছে যৎসামান্য শোনা এক পাগলিনীর কথা জিজ্ঞেস করে ঠাকুরদাকে। আগুনে ঘি ঢালার দশা! ঠাকুরদা কি বলবেন কোনো দিন তাকে সেই ইতিহাস! না। মোটামুটি অজানাই থেকে যাবে সে কিংবদন্তি নাতি সৌম্যর কাছে!

বউ নিয়ে নামকাওয়াস্তে সংসার করলেও বাবার মৃত্যুর পর আইএ পাস খুশিকে তারই এনজিওতে ফিল্ড অফিসারের চাকরি ম্যানেজ করে দিয়েছিল বিরু খ্যান। দুজনই যদি স্বাবলম্বী হয়, তাহলে গোল্লায় যাক অন্য সব! কিসের পরিবার, কিসের জাত কিংবা পাত! ফিল্ড আর দপ্তর মিলে সারা দিনভর আবারও চুটিয়ে প্রেম করার ফুরসত আসে তাদের।

আজ থেকে চল্লিশ বছরের আগের কথা। পথঘাট ‘ওকড়া’য় ভরপুর। কখনো ভরদুপুরে, কখনো পড়ন্ত বিকেলে পথে হাঁটে তারা। হেঁটে হেঁটে ফিল্ড থেকে দপ্তরে ফেরে। চোখ, কান বন্ধ করে কথা বলতে বলতে হারিয়ে যায় অনেক ভাব ও ভাবনার মোহনায়। পথে ‘ওকড়া’ বিঁধে যায় বিরুর প্যান্টে, খুশির সালোয়ারে। বাড়িতে ফেরার পর প্যান্ট ধোয়ার সময় বিরুর বউয়ের মন আনচান করে। ‘মোটরসাইকেল থাকতে এই লোক তো হাঁটার লোক নয়! তাহলে নিত্যে এত ওকড়া বাঁধে কীভাবে?’ সময় বসে নেই। বিরুর চালচলনে ভাবনাও বাড়ে বউয়ের।

তত দিনে পথ-ঘাট, বন-বাদাড়, ফিল্ড-দপ্তর মারিয়ে হয়তো ‘জাত’ গিয়েছিল বিরুর। কিংবা ‘জাত’ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ‘জাত’ একদম না গেলেও আকাশ-বাতাসে চাউর হয়েছিল ‘জাত’ গেছে বলে। বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে গ্রামের লোকজন হয়ে বাড়িতে সে খবর পৌঁছে যায়। সে খবর যে পৌঁছেছে বাড়িতে, সে খবর শুধু বিরু আর খুশির কাছে পৌঁছায় না!

ভাদ্র মাসের এক বৃষ্টিঝরা সকালে দপ্তরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল বিরু। এমন সময় বড় দাদা বলে, ‘আইজ কোনো ঠাঁই যাস ন্যা, বিরু। সাবরেজিস্ট্রার সাব আইসবে আইজ বাড়িতে।’ মাথায় বাজ পড়ে বিরুর। ‘হঠাৎ সাবরেজিস্ট্রার?! কী জন্য?…’ কারও মুখ থেকে কোনো জবাব না সরা দেখেই মোটামুটি একটা জবাব পেয়ে যায় সে। নিরুপায় হয়েই সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে মা, দুই দাদাসহ তাদের পরিবার ও বউয়ের সঙ্গে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে রাতারাতি দেশান্তরী হয় বিরু খ্যান!

সবকিছু গোল্লায় যাক! খুশির মায়া ত্যাগ করা কি এতই সহজ! না, সহজ ছিল না। দিনহাটায় গিয়ে একটু স্থির হয়ে চাকরির হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার ছল করে একদিন উলিপুরে আসে বিরু। কিন্তু হায়, তত দিনে চাকরিতে নেই আর খুশি। বুদ্ধিবিভ্রম হয়ে বাড়িতে বন্দী জীবন কাটে তার।

হয়তো সবকিছু ফেলে দিয়ে, জাত-পাত ভুলে গিয়ে খুশির সঙ্গে সংসার করার লোভেই ভারত থেকে এসেছিল বিরু। তা আর হলো কই!

তখনো কাঁটাতার ছিল না বন্ধুপ্রতিম দুটি দেশের সীমান্তে। কিন্তু কাঁটাতারের চেয়ে শক্তিশালী এক অদৃশ্য বাধার দেয়াল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে। দুটি মনের মধ্যে। বিরু আসত দুই-চার বছর পরপর। আবদুল হকের কাছে থেকে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করত খুশির। দূর থেকে একনজর দেখার চেষ্টা করত বিরহী হৃদয় নিয়ে। বেদনা জাগাত হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে।

শেষবার, আরও বছর দশেক আগের কথা। বিরু খ্যান যখন বাংলাদেশে এসেছিল, সৌভাগ্যক্রমে দেখতে পেরেছিল খুশিকে। তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। সন্ধ্যা নামে নামে ভাব। রাত নামার আগেই শুক্লপক্ষের চাঁদ হাসছিল নীল আকাশে। চুল, দাড়ি, গোঁফে ‘ভাকরুস’ শত জনমের চেনা বিরুকে কি চিনতে পেরেছিল ‘পাগলি’ খুশি? চেনার কথা নয়। চেনার হালেও নেই সে। সেটাই ছিল বিরুর খুশিকে শেষ দেখা! এবার এসে তিন-চার দিন বন্ধু আবদুল হকের বাড়িতে থেকেও একনজরও দেখতে পারেনি খুশিকে। তাকে না দেখার বেদনা নিয়েই ভারতে ফিরছে বিরু খ্যান। রৌদ্রপোড়া বাস চলছে। মন পড়ে আছে গিয়ে ‘পাগলি’ খুশির আশপাশে। যে খুশি আর কোনো দিন চিনতেও পারবে না তার বিরুকে!

-মোরশেদুল ইসলাম
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, কুড়িগ্রাম