বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সরকারি চাকরিজীবীদের আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে এই বিবরণী প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তবে নির্ধারিত সময়ে সম্পদ বিবরণী জমা না দিলে বা ভুল তথ্য প্রদান করলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে সরকারি চাকরিজীবীদের।
আরও পড়ুন: আসিফ মাহতাবকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখার দাবি
সম্পদ বিবরণী দাখিলের প্রক্রিয়া ও নিয়মাবলি
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ (সংশোধনী ২০০২)-এর অধীনে সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক।
দাখিল প্রক্রিয়া:
- ক্যাডার/নন-ক্যাডার (নবম বা তদূর্ধ্ব গ্রেড) কর্মকর্তা: নিজের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগীয় সচিবের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেবেন।
- গেজেটেড/নন-গেজেটেড কর্মকর্তা/কর্মচারী (১০ম থেকে ২০তম গ্রেড): নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন।
- নির্ধারিত ছকে সম্পদ বিবরণী প্রস্তুত করতে হবে, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাবে।
- সম্পদ বিবরণী সিলগালাকৃত খামে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।
গোপনীয়তা সংরক্ষণ:
- আদালতের আদেশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত সম্পদ বিবরণীর তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।
- এটি একটি অতি গোপনীয় দলিল হিসেবে গণ্য হবে এবং তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর আওতায় আসবে না।
আরও পড়ুন: মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি, নাকি যমজ ভাই? কোনটি সত্য- চলছে আলোচনা
সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে শাস্তি
যদি কোনো সরকারি কর্মচারী নির্ধারিত সময়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে ব্যর্থ হন, ভুল তথ্য দেন, তথ্য গোপন করেন অথবা সম্পদের অসঙ্গতি ধরা পড়ে, তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী এই শাস্তিগুলো আরোপ করা হতে পারে:
লঘুদণ্ড:
- তিরস্কার।
- নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা।
- সরকারের আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে বেতন বা আনুতোষিক থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়।
- বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ।
গুরুদণ্ড:
- নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ।
- বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান।
- চাকরি থেকে অপসারণ।
- চাকরি থেকে বরখাস্ত করা।
আরও পড়ুন: ৪৮ জেলায় ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ পাবেন ২৮,৮০০ জন, আছে দৈনিক ভাতা
উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। অতীতে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা কার্যকরভাবে পালন করা হয়নি। এতে দুর্নীতি বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন এই নির্দেশনা দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র সচিব জানিয়েছেন, এই উদ্যোগটি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি বড় পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক লেনদেন এবং সম্পদের বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
যদিও এই উদ্যোগটি প্রশংসিত হয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক কর্মকর্তা সময়মতো সম্পদের হিসাব দিতে ব্যর্থ হতে পারেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করতে পারেন। এজন্য কঠোর নজরদারি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপটি সুশাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে এটি সফল করতে জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও জরুরি।