স্বামীসহ পাঁচমাস ধরে কারাগারে বন্দি সাংবাদিক ফারজানা রূপা আদালতে দাঁড়িয়ে তার শিশুকন্যার কথা বিচারককে বললেন; সন্তানের জন্য হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে চাইলেন জামিন।
সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করলে শাকিল বলেন, “কথা বলতে মানা। মুখ বন্ধ আমাদের।”
অবশ্য তার সেই আর্জিতে সাড়া দেননি ঢাকার মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান। রূপা এবং তার স্বামী শাকিল আহমেদকে মিরপুর থানার এক হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দিয়েছেন তিনি।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
ফারজানা রূপা ও শাকিল আহমেদ: সাংবাদিক দম্পতির জীবন
ফারজানা রূপা বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট। আর শাকিল একই টেলিভিশনের সাবেক হেড অব নিউজ।
ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশ ছাড়ার চেষ্টার সময় ২১ অগাস্ট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদাবর থানার এক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য সোমবার সকালে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার হাকিম আদালতের গারদখানায় এনে রাখা হয় ফারজানা রূপাকে। আর শাকিল আহমেদকে আনা হয় কেরানিগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে।
আরও পড়ুন: নিরাপত্তা বাহিনীতে সংস্কার- পুলিশ, র্যাব ও আনসারের নতুন পোশাক
কিছুক্ষণ পর মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামানের আদালতে হাজির করতে প্রস্তুত করা হয় রূপাকে। হাতে হাত কড়া, গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট পরানো হয় তাকে।
এরপর রূপাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আরিফ হাসানের সঙ্গে এজলাসে তোলা হয়।
এজলাসে উঠে কাঠগড়ায় ঢোকার পর স্বামী শাকিল আহমেদকে খুঁজতে থাকেন রূপা।
মিনিট পনের পর সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের সঙ্গে হাজতখানা থেকে সাংবাদিক শাকিলকেও এজলাসে তোলা হয়।
শাকিল কাঠগড়ায় উঠতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন রূপা। এই দম্পতি নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে থাকেন। কখনো কানে কানে, কখনো হাসি মুখে তাদের গল্প করতে দেখা যায়। কাঠগড়ায় যতক্ষণ ছিলেন, নিজেদের মধ্যে তারা কথা বলছিলেন।
কিছুক্ষণ পর মিরপুর থানার এ মামলায় শাকিল ও রূপাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদনের শুনানি শুরু হয়। এ সময় রূপা আদালতের কাছে কথা বলার অনুমতি চান।
বিচারক তাকে ‘আইনের ভেতরে থেকে’ কথা বলতে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে রূপা কাঠগড়ার সামনের দিকে এসে বলেন, “আমার ছোট্ট শিশু সন্তান আছে। আমি আর আমার স্বামী দুইজনই কারাগারে। ৬ মাস হয়ে গেছে। আমাকে জামিন দিন। আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই।”
আরও পড়ুন: টিউলিপের পর এবার ফেঁসে যাচ্ছেন পুতুল, বড় অ্যাকশনে দুদক
শুনানি শেষে আদালত রূপা ও শাকিলের আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের মিরপুরের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন।
এ সময় রূপা ও শাকিল দুজনকেই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করলে শাকিল বলেন, “কথা বলতে মানা। মুখ বন্ধ আমাদের।”
এরপর অন্য মন্ত্রী-এমপি আসামিদের মত রূপা ও শাকিলকেও কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১০ অগাস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে একটি চিঠি পাঠায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তাতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য ৫০ জন সাংবাদিকের একটি তালিকা দিয়ে বলা হয়, এসব সাংবাদিক প্রতিনিয়ত পুলিশ ও আওয়ামী লীগকে মদদ এবং উসকানি দিয়েছেন। এভাবে তারা ছাত্রদের বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধে জড়িত ছিলেন। ওই তালিকায় শাকিল ও রূপার নামও ছিল।
ওই তালিকা প্রকাশের আগেই গত ৮ অগাস্ট শাকিল ও রূপাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।
তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয় সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা দুই বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) ও কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি তাদের মুক্তি দেওয়ারও আহ্বান জানায় সংগঠন দুটি।
গ্রেপ্তার সাংবাদিক দম্পতি রুপা-শাকিলের পক্ষে জাতিসংঘে অভিযোগ
সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পক্ষে তাঁদের আন্তর্জাতিক আইনজীবী দল জাতিসংঘে অভিযোগ করেছে। দম্পতি আটককে ‘স্বেচ্ছাচারী’ অভিহিত করে গত বুধবার (২২ জানুয়ারি) আইনজীবীরা এই অভিযোগ করেন।
মানবাধিকার আইনজীবী কাওয়েলফিওন গ্যালাঘার ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, সমালোচকদের দমন করতে আইন ব্যবহারের হাস্যকর (অ্যাবসার্ড) উদাহরণ। দুঃখজনকভাবে, এর ফলে তাঁরা এখনো কারাগারে রয়েছেন।
এ সাংবাদিক দম্পতির পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গ্যালাঘার।
গ্রেপ্তারের পর থেকে দম্পতিকে ১৫০ দিনের বেশি সময় ধরে কারাগারে রাখা হয়েছে। তাঁদের আইনি দল দাবি করেছে, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
লন্ডনভিত্তিক আইনজীবী গ্যালাঘার ভিওএকে বলেন, এটি সরকারের প্রতিশোধমূলক আইনের একটি উদাহরণ। সমালোচকদের দমন করতে আইনকে অপব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকতা এমন মানসিকতার জন্ম দিতে পারে এবং সে মানসিকতা আক্রমণ ও খুনের কারণ হতে পারে—এ ধরনের দাবি আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থহীন।
ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আর্বিট্রারি ডিটেনশনে অভিযোগ করে গ্যালাঘার আশা প্রকাশ করেন, ‘এ দম্পতির কারাবাসকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ হিসেবে চিহ্নিত করবে জাতিসংঘের এ গ্রুপ। আমরা যা দেখছি তা হলো, কোনো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই তাঁদের পুরোপুরি অন্যায্যভাবে কারাগারে রাখা হয়েছে।’
দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদকে তাঁদের মেয়েসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়।
পরিবারটি টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট টিকে-৭১৩-এ ইস্তাম্বুল হয়ে প্যারিসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তবে পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্র না থাকায় ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের দেশত্যাগের অনুমতি দেয়নি।
সুত্র: বিডি নিউজ ও আমাদের সময়