রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশে নতুন করে আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। আগামী ১৬ই ফেব্রুয়ারি ও ১৮ই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ‘কঠোর’ হরতাল এবং অবরোধের ডাক দিয়েছে দলটি।
এই কর্মসূচি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদত্যাগ এবং সরকারের ‘অপশাসন-নির্যাতনের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঘোষণা করা হয়েছে। দলটি দাবি করছে, তাদের আন্দোলন মূলত জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
কর্মসূচির ঘোষণার পটভূমি
এখন থেকে কয়েক মাস আগে, ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনা, দলের সভাপতি, সহ অধিকাংশ শীর্ষ নেতারা বিদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং দলের অনেকে পলাতক অথবা কারাগারে বন্দী আছেন।
কিন্তু গত মঙ্গলবার রাত ৮টায় দলের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এই আন্দোলনের ঘোষণা আসে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে দলটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে নামবে এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ কর্মসূচি
আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, পহেলা ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে শুরু হবে একটি ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম। এই দিন থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দলটি বিভিন্ন এলাকায় লিফলেট, প্রচারপত্র বিলি করবে, যেখানে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরা হবে।
আরও পড়ুন: ফারজানা রূপা: কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি- জাতিসংঘে অভিযোগ
আওয়ামী লীগ বলছে, এই প্রচারপত্রে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলে ধরবে এবং জনগণকে তাদের দাবির পক্ষে সমর্থন জানাতে আহ্বান করবে।
এর পর ৬ই ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিল এবং সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশগুলোতে বক্তারা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানাবেন এবং দেশের জনগণকে সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে আহ্বান করবেন। এরপর ১০ই ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশের মাধ্যমে দলের প্রতিবাদ আরও তীব্র হবে।
১৬ই ফেব্রুয়ারি, রোববার, আর ১৮ই ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ঘোষণা করা হয়েছে সর্বাত্মক ‘কঠোর’ হরতাল। এই হরতাল সারা দেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
দলের পক্ষ থেকে হরতাল চলাকালে কোনো রকম যানবাহন চলাচল না করতে বলা হয়েছে এবং দোকান-পাট, অফিস-আদালত বন্ধ রাখারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে, এই প্রতিবাদ কর্মসূচির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার বিচার এবং ‘প্রহসনমূলক বিচার’ বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্যে
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা কর্মসূচি শুধু একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নয়, এটি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য চালানো হচ্ছে বলে দলটির নেতা-কর্মীরা দাবি করছেন। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের আন্দোলন বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
আরও পড়ুন: নিরাপত্তা বাহিনীতে সংস্কার- পুলিশ, র্যাব ও আনসারের নতুন পোশাক
তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার দেশে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে ফেলছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, দলটি জনগণের প্রতি এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
এই প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আরও একবার তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চাইছে। দলের নেতারা দাবি করছেন, সরকারের নানা পদক্ষেপে দেশের মানুষের জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, এবং তারা সাধারণ মানুষের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
এই ঘোষণা প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে শক্তি দিয়ে দমন করার চেষ্টা হতে পারে, বিশেষ করে যখন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পুলিশের শক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক বিরোধে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে গেছে, এবং বিশেষ করে বিভিন্ন বিরোধী দলের উপর সরকার যে ‘নির্যাতন’ চালাচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে।
আরও পড়ুন: টিউলিপের পর এবার ফেঁসে যাচ্ছেন পুতুল, বড় অ্যাকশনে দুদক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আগে থেকেই বিরোধী দলের প্রতিবাদ আন্দোলন ও সমাবেশগুলো কঠোরভাবে দমন করে আসছে, ফলে দলের নেতারা ধারণা করছেন, তাদের চলমান প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়া একই ধরনের হতে পারে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অবস্থা
বর্তমানে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা দেশ থেকে বাইরে অবস্থান করছেন। দলের অনেক শীর্ষ নেতা পলাতক, কারাগারে অথবা বিদেশে চলে গেছেন।
দলটির বেশিরভাগ কার্যক্রম বর্তমানে বিদেশ থেকেই পরিচালিত হচ্ছে, আর নেতৃত্বের বেশ কিছু দায়িত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সহ অন্যান্য নেতাদের হাতে রয়েছে।
এদিকে, গত ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের কোনও উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি বা রাজনৈতিক কার্যক্রম দেশে তেমন সক্রিয় ছিল না।
১০ই নভেম্বর তারা রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে, এই মুহূর্তে তারা আবার বড় আকারে আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এবং এই বার্তা সরকারের কাছে পৌঁছাতে চাইছে।
আগামী দিনে আওয়ামী লীগের আন্দোলন
আওয়ামী লীগের এই আন্দোলন একদিকে যেমন সরকারের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ, অন্যদিকে এটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। দলটি তাদের নিজস্ব শিরোপা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে, এবং জনগণের কাছে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে।
দলের নেতারা এখনই বাংলাদেশের মানুষকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন, এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততটা উত্তপ্ত হওয়ার আগে সরকারের প্রতি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছেন।
বিগত সময়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের একে অপরকে সমর্থন করার চেষ্টা এবং সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত ছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির নেতারা মনে করছেন যে তাদের আন্দোলন এবং কর্মসূচি সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাবে।
এদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দেশব্যাপী এক বিরাট গণআন্দোলনে পরিণত হতে পারে, যেখানে সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা চলছেই, এবং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অন্ধকারে।
সুত্র: বিবিসি