দেশের মানুষ সুখী না, কিন্তু কেন?

সুখী মানুষ

বাংলাদেশের মানুষ কেন সুখী না, এই প্রশ্নটি অনেকের মনে ঘুরপাক খায়। সুখ এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেকের জীবনে অপরিহার্য। এই দেশটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশেলে এক অনন্য সমাজ গড়ে উঠেছে, সেখানে মানুষের সুখের সন্ধানে এক অদৃশ্য অস্থিরতা বিরাজ করে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। দিন দিন সুখের সূচকে পিছিয়ে পড়ছে। এই পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে কী কারণ রয়েছে? কেন এই দেশের মানুষ সুখী নয়?

আরও পড়ুন : পরের বেলা ভাত জুটবে কিনা জানে না ৩৪ লাখ মানুষ

সুখী দেশের তালিকা

সুখী দেশের তালিকা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯তম অবস্থানে, যা গত বছরের মতো এবারও ১১ ধাপ পিছিয়েছে। এই তালিকায় সুখী দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ও সুইডেন রয়েছে। এই তালিকা নির্ধারণে ব্যবহার করা হয় ৬টি সূচক, যাতে শামিল হয় মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবন-যাপনের প্রত্যাশা, জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, বদান্যতা, দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব ও ডিসটোপিয়া।

বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছে, যার কারণ হচ্ছে সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং সন্তুষ্ট হওয়ার অসম্ভবতা। এই সূচকগুলোর সাথে বাংলাদেশ তেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কারণ তালিকায় শীর্ষ পর্যায়ে থাকা বেশিরভাগ দেশেই ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের, যাদের জিডিপির আকার অনেক বড় এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সবল ভূমিকা পালন করে।

সুখ খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে গবেষণা

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘ বছর ধরে গবেষণা করছেন সুখ খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে, যাতে দাবি করা হয় যে, মানুষ চাইলেই সুখ খুঁজে পেতে পারেভ তবে সে ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার, সফলতা বা অর্থ-সম্পদের মধ্যে খুঁজলে হবে না, বলে গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। সুখে থাকার জন্য দরকার মানুষ, দরকার পরিবার আর বন্ধু মিলিয়ে চারপাশে সুন্দর একটা সামাজিক সুস্থতা তৈরি করা।

কেন অসুখী বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের মানুষ কেন সুখী নয়, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে সুখের সূচকে দেশটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। জাতিসংঘের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস (World Happiness Index) রিপোর্টে  বিশ্ব সুখ সূচকে  বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে ৯৪তম স্থানে থাকা বাংলাদেশ ২০২৩ সালে ১১৮তম স্থানে নেমে এসেছে এবং ২০২৪ সালে ১২৯তম অবস্থানে রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১১ ধাপ পিছিয়ে। এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা দেশের মানুষের সুখের অনুভূতিতে প্রভাব ফেলছে।

আরও পড়ুন: বিয়ের জন্য বাংলাদেশে গড় ঋণের পরিমাণ প্রায় লাখ টাকা

**মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়:**

বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মানুষের সুখের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। চাল, ডাল, তেল সহ প্রায় সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। এই মূল্যস্ফীতির ফলে অনেক পরিবারে একবেলা খাবার জোটানোও দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

**দারিদ্র্য ও আয়ের অসমতা:**

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক চাপের কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৪১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সরকারের দাবি অনুযায়ী কম হলেও বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী আয়ের হ্রাস পাওয়া গেছে।

**চোরাচালান ও মাদক সরবরাহ:**

সীমান্তে চোরাচালান এবং মাদক সরবরাহ বন্ধে সরকারের তৎপরতা সত্ত্বেও এই সমস্যাগুলি অব্যাহত রয়েছে, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং অসুখী জীবনযাত্রার একটি কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

**সরকারি নীতি ও বাজার মনিটরিং:**

বাজার মনিটরিং এবং নীতি নির্ধারণে ঘাটতি থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে জিরো টলারেন্স নীতির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।

**সুখের উপাদান অনুপস্থিত:**

ফিনল্যান্ডের মতো সুখী দেশগুলোতে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ, অবসর সময়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে নগরায়ণের ফলে এসব সুখের উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে। একক পরিবারে বসবাস, ঘিঞ্জি কর্মপরিবেশ মানুষকে বিমর্ষ করে তুলছে।

সমাধানের পথ

  • – বাজার মনিটরিং জোরদার করে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে
  • – দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে
  • – আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করে সামাজিক স্থিতিশীলতা আনতে হবে
  • – পরিবার ও সমাজের বন্ধন জোরদার করতে উদ্যোগ নিতে হবে
  • – প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে

সুখী দেশ গড়তে সরকার ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে মানুষের কাঙ্ক্ষিত সুখ ফিরিয়ে আনাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

Juger Alo Google News   যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন