নতুন শিক্ষা কারিকুলাম-এ যুক্ত হচ্ছে আরবি: বাদ পড়ছে ৪ লেখকের গল্প প্রবন্ধ

বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন শিক্ষা কারিকুলাম আনার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অতিরিক্ত সাবজেক্ট হিসেবে আরবি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

আরও পড়ুন: জাবির নবীন শিক্ষার্থীর মাঝে দেড় হাজার কপি কুরআন বিতরণ

এছাড়া উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা সাহিত্য পাঠেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের লেখা ও প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে বাদ পড়া লেখকের তালিকায় রয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রখ্যাত লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।

মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম-এ আরবি

২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে আরবি ভাষা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আগামী বছর থেকে মোট ১৩টি সাবজেক্ট পাবে, যার মধ্যে ১৩ নম্বর সাবজেক্ট হিসেবে আরবি যুক্ত হবে। এনসিটিবি জানিয়েছে যে, পুরনো ২০১২ সালের কারিকুলামে আরবিকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আরবি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা এবং ইসলামের প্রতি আরও ভাল ধারণা সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উচ্চমাধ্যমিকে লেখক ও প্রবন্ধ পরিবর্তন

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বাংলা সাহিত্য পাঠ্যসূচিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে ২৮টি গদ্য এবং ২৮টি পদ্যের মধ্যে কয়েকটি গল্প ও কবিতা পরিবর্তন করা হয়েছে। চারজন বিশিষ্ট লেখকের রচনা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং তিনজন লেখকের লেখা পরিবর্তন করা হয়েছে।

বাদ পড়া লেখকের তালিকায় রয়েছেন:

  1. শেখ মুজিবুর রহমান – তাঁর লেখা ‘বায়ান্নর দিনগুলো’।
  2. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল – তাঁর লেখা ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’।
  3. দিলওয়ার – তাঁর লেখা ‘মানুষ সকল সত্য’।
  4. মহাদেব সাহা – তাঁর লেখা ‘শান্তির গান’।

পরিবর্তন করা লেখকদের তালিকায় রয়েছেন:

  1. প্রমথ চৌধুরী – তাঁর লেখা ‘বর্ষা’ প্রবন্ধের পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে ‘সাহিত্যের খেলা’।
  2. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন – তাঁর লেখা ‘গৃহ’ পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে ‘অর্ধাঙ্গী’।
  3. কাজী নজরুল ইসলাম – তাঁর লেখা ‘আমার পথ’ পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে ‘যৌবনের গান’।

লেখার অনুশীলনীতে পরিবর্তন ও সম্পাদনা

এছাড়াও পাঁচজন লেখকের লেখা সম্পাদনা বা পরিমার্জনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

  1. শওকত আলী – ‘কপিল-দাস মুর্মুর শেষ কাজ’।
  2. কাজী নজরুল ইসলাম – ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘সাম্যবাদী’।
  3. আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ – ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’।
  4. সৈয়দ শামসুল হক – ‘নুরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’।

এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে সাহিত্য পাঠের গুণগত মান এবং শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাসঙ্গিকতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের পটভূমি

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট বেশ আলোচিত। ৫ আগস্টের পর ছাত্রজনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০১২ সালের পুরনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সেই কারিকুলামে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিটিবি জানিয়েছে, বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিলের গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং নতুন পাঠ্যসূচির বই মুদ্রণ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর বেরোবির হলের মসজিদে মাইকে আযান

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি এম রিয়াজুল হাসান জানান, “বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল করে পুরনো ২০১২ সালের কারিকুলামে ফিরে গেলেও, বর্তমান বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার তাগিদে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে হয়তো সব পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না, তবে নিয়মিত প্রসেসের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”

আরবি শিক্ষার গুরুত্ব

নতুন কারিকুলামে আরবি অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইসলামী শিক্ষার বাইরে অতিরিক্ত হিসেবে আরবি ভাষা যুক্ত করা হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের আত্ম-উন্নয়নেও সহায়ক হবে। ২০১২ সালের কারিকুলামের আনন্দ পাঠ হিসেবে পরিচিত বাংলা রেপিডও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই পাঠ্যসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দ্রুত পাঠের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সাহিত্যের পর্যালোচনা

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য পাঠেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। মোট ২৮টি গদ্য এবং ২৮টি পদ্যের মধ্যে, লেখক এবং লেখা বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে সাহিত্যের পাঠের গভীরতা এবং প্রসঙ্গিকতা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ২১ বছর পর ঢাবির হলে মাইকে আযান: আবেগে আপ্লুত শিক্ষার্থীরা

এছাড়া, সাহিত্য পাঠের অনুশীলনীতে যে পাঁচটি রচনায় সম্পাদনা আনা হচ্ছে, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়গুলোকে আরও প্রাসঙ্গিক করা এবং তাদের মধ্যে সাহিত্যিক রুচি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা উন্নয়ন করা। বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ লেখকদের রচনা পরিবর্তনের মাধ্যমে সাহিত্যের পাঠে নতুন মাত্রা আনা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি এবং মননশীলতা উন্নয়নে সহায়ক হবে।

কারিকুলাম পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া

কারিকুলামের এই পরিবর্তনকে শিক্ষাবিদরা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করছেন। একদিকে কিছু শিক্ষাবিদ মনে করেন যে, এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের আধুনিক জ্ঞান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটাবে। অন্যদিকে, কিছু শিক্ষাবিদ প্রশ্ন তুলেছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো বিশিষ্ট লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের ইতিহাস এবং সমাজের প্রতি সংবেদনশীলতা হারাতে পারে।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের ‘আপনি’ সম্বোধন করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ

এনসিটিবি জানিয়েছে, পরিবর্তন আনতে গিয়ে তারা সমস্ত পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা করেছে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য এমন এক পাঠ্যসূচি তৈরি করতে চাই, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য আরও উপযুক্ত হবে এবং যাতে তারা তাদের শিক্ষাজীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।”

ভবিষ্যতের লক্ষ্য

বর্তমান কারিকুলামে আনা পরিবর্তনগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলার লক্ষ্যেই করা হয়েছে। এনসিটিবি জানিয়েছে যে, তারা নিয়মিতভাবে পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আরও পরিবর্তন আনবে। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া গ্রহণের মাধ্যমে কারিকুলামের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন: ষষ্ঠ-নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার সিলেবাস এবং নমুনা প্রশ্ন প্রকাশ

সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় আরবি ভাষা অন্তর্ভুক্তি এবং বাংলা সাহিত্য পাঠের বিভিন্ন পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নতুন বিষয়গুলোর মাধ্যমে আরও গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং তাদের আত্মউন্নয়ন ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

Juger Alo Google News   যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

3 thoughts on “নতুন শিক্ষা কারিকুলাম-এ যুক্ত হচ্ছে আরবি: বাদ পড়ছে ৪ লেখকের গল্প প্রবন্ধ”

Leave a Comment