ঢাবিতে বোরকা-হিজাব পরায় শিক্ষার্থীকে ‘থুতু’ নিক্ষেপ ও হেনস্তার অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বোরকা ও হিজাব পরিধান করায় এক নারী শিক্ষার্থীর গায়ে থুতু নিক্ষেপ ও শারীরিকভাবে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা ক্যাম্পাসজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজ এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

ঘটনাটি ঘটে বুধবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের (কার্জন হল সংলগ্ন) এলাকায়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনার্স শ্রেণির ছাত্রী। তিনি ঘটনার পর তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিস্তারিত লিখে বিষয়টি জনসমক্ষে আনেন।

আরো পড়ুন: Adsterra Account খুলুন আর প্রতিদিন ২-৩ ডলার আয় করুন

আরো পড়ুন: Sprout Gigs থেকে Website Visit আয় করুন খুব সহজে

আরো পড়ুন: ফ্রিল্যান্সিং কি? কী করবেন, কী করবেন না – ইসলাম কি বলে?

ঘটনার বিবরণ

ভুক্তভোগী তার পোস্টে লিখেছেন, “ক্লাস শেষে কার্জন হল থেকে ফিরছিলাম। জুলোজি ডিপার্টমেন্টের দিকের রাস্তায় হঠাৎ এক নারী আমার দিকে থুতু নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন—‘আরেহ তুই ঐখানকার মেয়ে না? সব পাকিস্তানি! কোথা থেকে মুখ পুড়িয়েছিস যে মুখ ঢেকে রেখেছিস?’ এরপর খপ করে আমার হাত ধরে বলেন—‘হাত এত খারাপ যে ঢেকে রেখেছিস? আগুনে পুড়েছে নাকি?’”

তিনি আরও লিখেন, “আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। অনেক কষ্টে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে হলে ফিরে আসি। এখনো মনে হচ্ছে গালিগুলো কানে বাজছে।”

ঘটনার পর ওই শিক্ষার্থী ভয় ও মানসিক ট্রমায় আছেন বলে তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন।

প্রতিবাদ ও অভিযোগ জমা

পরদিন বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও বিভিন্ন হল সংসদের নেতাকর্মীরা প্রক্টর অফিসে লিখিত অভিযোগ জমা দেন।

অভিযোগ জমা দেওয়ার পর ডাকসু সদস্য সাবিকুন্নাহার তামান্না সাংবাদিকদের বলেন,

“আমরা প্রশাসনের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছি। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই তাদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে হয়েছে। প্রক্টর অফিস আমাদের কাছ থেকে দুই দিন সময় চেয়েছে, যা ভুক্তভোগীর জন্য অনেক দীর্ঘ সময়।”

তিনি আরও বলেন,

“ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি ফুটেজ নেই—এটা খুবই উদ্বেগজনক। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী চলাচল করে। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা প্রশাসনিক ব্যর্থতা।”

প্রক্টর অফিসের বক্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন,

“আমরা অভিযোগটি পেয়েছি এবং বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। যদি ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে সহায়তার জন্য একটি তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে, যারা আশেপাশের সাক্ষীদের বক্তব্য নিচ্ছেন এবং নিকটস্থ এলাকায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে।
অনেকেই এটিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে মনে করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থী লেখেন,

“ঢাবি এমন একটি জায়গা, যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমানভাবে নিরাপদ থাকবে। সেখানে পোশাকের কারণে একজন নারীকে অপমান করা লজ্জাজনক।”

অন্যদিকে একজন নারী অধিকারকর্মী ফেসবুকে লিখেছেন,

“এটি কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং নারী স্বাধীনতা ও ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর আঘাত। প্রশাসন যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এরকম ঘটনা আরও বাড়বে।”

বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে আলোচনা

ঢাবির শিক্ষার্থীদের একাংশ বলছে, এটি ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য বড় একটি পরীক্ষা।
একজন শিক্ষার্থী বলেন,

“যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মুক্তচিন্তার কথা বলি, সেখানে কারও পোশাক দেখে তাকে অপমান করা দুঃখজনক। প্রশাসনের উচিত দ্রুত অপরাধীকে খুঁজে বের করা।”

অন্যদিকে ক্যাম্পাসের কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন,

“বিশ্ববিদ্যালয়কে নিরাপদ শিক্ষাঙ্গনে পরিণত করতে হলে এসব ঘটনায় দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। নইলে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হবে।”

বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে হিজাব বা বোরকা পরিধান করা সাংবিধানিক অধিকার। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিকভাবে এ বিষয়ে নানা বিভাজন দেখা যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ধর্মীয় পোশাকের কারণে নারীদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য উদ্বেগজনক।

বিশেষজ্ঞদের মত

সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন,

“এটি শুধু ব্যক্তি আক্রমণ নয়, বরং সামাজিক মনস্তত্ত্বের বিকৃতি। নারী যখন ধর্মীয় পোশাক পরে, তখন তাকে টার্গেট করা মানে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবমাননা।”

তিনি আরও বলেন,

“বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখনই উচিত ক্যাম্পাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসিটিভি স্থাপন করা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা।”

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে যেন দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।
তাদের মতে, “ঢাবির ইতিহাস স্বাধীনতা ও সহাবস্থানের। সেখানে হিজাব বা পোশাকের কারণে কেউ হেনস্তার শিকার হলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার জন্যও বড় আঘাত।”

এই ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা—সবকিছুর ওপর প্রশ্ন তুলেছে। প্রশাসন যদি দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না নেয়, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও বড় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, তদন্ত চলছে এবং দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Juger Alo Google Newsযুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News নিউজ অনুসরণ করুন

Leave a Comment