বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন এক মোড় নিয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার খবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় উত্থাপিত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ ও ‘গণহত্যা’র অভিযোগে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর একটি গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
মামলার বাদী হচ্ছেন লন্ডন ভিত্তিক ‘থ্রি বোল্ট কোর্ট চেম্বার্স’-এর ব্যারিস্টার মো. আশরাফুল আরেফিন। তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম স্ট্যাটিউটের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
আরও পড়ুন: জাতীয় পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা হাসনাত আবদুল্লাহর
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, Sheikh Hasina ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রাজনৈতিকভাবে উদ্বেগজনক একটি সময়ে আসছে যখন দেশের আইনগত ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে, এই মামলার সাথে যুক্ত রয়েছেন আরো দুই ব্রিটিশ আইনজীবী, ব্যারিস্টার সারাহ ফোরে ও ব্যারিস্টার এমিল লিক্সান্দ্রু। তাদের মতে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইসিসি থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রদান করবে।
আশরাফুল আরেফিন বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের সামনে এসেছে। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, গোপন বন্দিশালায় নির্যাতন এবং গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধ।’ তার এই মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, সরকারী পদক্ষেপের ফলে অনেক আন্দোলনকারী নিখোঁজ হয়েছেন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আশরাফুল আরেফিনের মতে, এই সমস্ত ঘটনাগুলি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের উদাহরণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী আশরাফুল আরেফিন, গত জুলাই ও আগস্টে আন্দোলনের সময়কার ঘটনাগুলোকে ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের এক পৈশাচিক নৃশংসতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এই কঠোর ব্যবস্থা জনগণের উপর এক বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অসংখ্য বিক্ষোভকারী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।’
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এই গুরুতর অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে সক্ষম হবে কিনা, তা নিয়ে ‘যথেষ্ট সন্দেহ’ রয়েছে। এই সন্দেহের কারণেই আইসিসিতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, কারণ আইনজীবীরা মনে করেন স্থানীয় আদালতগুলি সরকারী চাপের অধীনে হতে পারে।
আরও পড়ুন: ৬ বার বদল আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সিঙ্গাপুর ভ্রমণের প্রস্তাব
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যখন তীব্র আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যান, তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়। আইসিসিতে মামলার দায়েরের পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত থেকে রাজনৈতিক সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনার কারণে স্থানীয় আদালতে ঘোষিত কোনো দণ্ড কার্যকর হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, তবে ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য বাধ্য হতে পারে। এর ফলে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে চাপ বাড়বে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যেখানে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই মামলা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
প্রসঙ্গত, আইসিসির এই মামলায় ভুক্তভোগীদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নিপীড়নের প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে সাক্ষী, ভিডিও প্রমাণ এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন দেখা যাক, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মামলা কতটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে এবং এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যেখানে একটি রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে অভিযোগ উঠছে। এই ধরনের ঘটনাগুলি শুধু একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থানকেই পরিবর্তন করে না, বরং তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক সমীকরণকেও প্রভাবিত করে।
সমগ্র বিশ্বে এই মামলার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন আলোচনার সূচনা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মামলা আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে, যা একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
এইসব কারণে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইসিসিতে দায়ের করা মামলাটি শুধুমাত্র আইনগত চ্যালেঞ্জই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।
3 thoughts on “এবার আইসিসিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা”