শীতের ঠান্ডা বাতাস আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের ত্বকে শুষ্কতার সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। ত্বকের এই শুষ্কতা কখনো কখনো এতটাই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে যে, তা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। শুষ্ক ত্বকের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে, “কোন ভিটামিনের অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়” সেই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভিটামিন সি-এর ঘাটতি। শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব হলে ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন কমে যায়, যা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। আসুন, শীতে ত্বক শুষ্কতা রোধে কীভাবে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং কীভাবে সহজ উপায়ে এই ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত জানি।
আরও পড়ুন: মাথা ব্যথা কি? কারণ, প্রকারভেদ, প্রতিকার ও ঘরোয়া উপায়: বিস্তারিত গাইড
কোন ভিটামিনের অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়
শীতকাল এলেই আমাদের ত্বকে শুষ্কতার প্রভাব প্রকটভাবে দেখা দেয়। ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে ত্বকের আর্দ্রতা দ্রুত হারায়, ফলে ত্বক হয়ে পড়ে শুষ্ক ও রুক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে শুধুমাত্র শীতকালীন আবহাওয়া নয়, বরং আমাদের শরীরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের অভাবও দায়ী। শরীরে বিশেষ করে ভিটামিন সি এর অভাব হলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথাও অনুভূত হতে পারে।
পুষ্টিবিদরা পরামর্শ দেন, ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং শীতকালে শুষ্কতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি এর অভাব ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা ত্বককে শুষ্ক করে তুলতে সহায়ক। এই ভিটামিনের ঘাটতি শুধুমাত্র ত্বকেই প্রভাব ফেলে না, এটি আরও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। নিচে ভিটামিন সি এর অভাবে শরীরে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার একটি বিস্তৃত আলোচনা দেওয়া হলো।
কোন ভিটামিনের অভাবে ত্বক শুষ্ক হয় এবং এর অভাবে কী কী সমস্যা হতে পারে?
১. শুষ্ক ত্বক
ভিটামিন সি ত্বকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা ত্বককে কোমল ও মসৃণ রাখতে সহায়ক। যখন শরীরে এই ভিটামিনের অভাব দেখা দেয়, তখন ত্বক শুষ্ক এবং নিস্তেজ হয়ে ওঠে। এর ফলে ত্বকে কুঁচকে যাওয়া এবং কোলাজেনের অভাবে ত্বকের উপরিভাগে ক্ষতির সৃষ্টি হয়, যা শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় আরও খারাপ রূপে প্রকাশ পায়। তাই ত্বকের শুষ্কতা রোধ করতে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখতে ভিটামিন সি-এর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন: ঘুমের আগে বালিশের নিচে রসুন রেখে দেখুন ম্যাজিক
২. জয়েন্টের ব্যথা
ভিটামিন সি এর অভাবে জয়েন্টের সমস্যাও বৃদ্ধি পায়। কোলাজেনের ঘাটতি হাড় ও জয়েন্টে প্রভাব ফেলে, কারণ জয়েন্টের কার্টিলেজ মূলত কোলাজেন দিয়েই তৈরি। ফলে হাড়ের চারপাশে প্রয়োজনীয় প্যাডিং বা কুশনিং না থাকায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। ঠান্ডার সময়ে ভিটামিন সি এর ঘাটতির কারণে জয়েন্ট এবং হাড়ের চারপাশে প্রদাহ ও ফোলাভাবও দেখা যায়, যা স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে।
৩. ক্ষত নিরাময়ে সমস্যা
ভিটামিন সি-এর অপর্যাপ্ততা ত্বকের ক্ষত দ্রুত সারাতে বাধা দেয়। কোলাজেন উৎপাদনের অভাবে ক্ষত নিরাময়ের প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হয়। তাছাড়া, এই ভিটামিনের ঘাটতির ফলে সংক্রমণের বিস্তারও বৃদ্ধি পায়। তাই শীতকালে শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ক্ষত দ্রুত সারাতে এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সহায়ক হয়।
৪. দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। শরীরে ভিটামিন সি এর অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ত্বক শুষ্ক হওয়ার পাশাপাশি ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: এমপক্স কি? এটি কিভাবে ছড়ায়? জেনে নিন এর ইতিাহস, লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা
৫. ওজন বৃদ্ধি
ভিটামিন সি এর অভাবে শীতকালে আকস্মিক ওজন বৃদ্ধি হতে পারে, যা অনেকের ক্ষেত্রে পেটে চর্বি জমা করার প্রবণতা তৈরি করে। ভিটামিন সি-এর অভাবে শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়, যা ফলে ওজন বাড়তে শুরু করে। তাই ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভিটামিন সি এর পর্যাপ্ত গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
৬. দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য
ভিটামিন সি-এর অভাবে দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। শরীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি হলে কোলাজেনের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে মাড়ি ফোলা এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। যদি এই ঘাটতি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দাঁত পড়ে যাওয়ার মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৭. অবিরাম ক্লান্তি
ভিটামিন সি-এর অভাবে শরীরে ক্লান্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি দেহের অভ্যন্তরে শক্তির ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং কাজে অনীহা, খিটখিটে মেজাজের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শীতে ত্বক শুষ্ক হওয়া রোধে প্রস্তুতি এবং যত্ন
নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার
মুখ এবং শরীরের ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার অপরিহার্য। শীতকালে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল দ্রুত হারিয়ে যায়, তাই গোসলের পরপরই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। রাসায়নিক ময়েশ্চারাইজারের চেয়ে প্রাকৃতিক তেল যেমন অলিভ অয়েল, নারকেল তেল ত্বকের জন্য বেশ উপকারী।
গরম পানিতে গোসলের নিয়ম
গরম পানিতে দীর্ঘ সময় গোসল ত্বকের প্রাকৃতিক তেল দূর করে। তাই শীতে কুসুম গরম পানিতে গোসল করা ভালো। গোসল শেষে নরম তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে ময়েশ্চারাইজার লাগানো প্রয়োজন, যা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়ক।
ঠোঁটের যত্ন
শীতকালে ঠোঁট ফাটা সাধারণ সমস্যা। ত্বক শুষ্ক হওয়া প্রতিরোধে ভ্যাসলিন, লিপজেল বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা যেতে পারে। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজানো উচিত নয়, কারণ এতে ঠোঁটের আর্দ্রতা আরও হারিয়ে যায়।
পায়ের যত্ন
শীতকালে পায়ের পাতায় শুষ্কতা দেখা দিতে পারে। পা শুষ্ক রাখার জন্য কুসুম গরম পানিতে পা ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার বা নারকেল তেল লাগানো জরুরি। যারা পা ফাটার সমস্যায় ভুগছেন, তারা ক্র্যাক হিল রিপেয়ার ক্রিম ব্যবহার করে মোজা পরে ঘুমাতে পারেন।
পর্যাপ্ত পানি পান
শীতকালে সাধারণত আমরা কম পানি পান করি, যা ত্বকের শুষ্কতার অন্যতম কারণ। ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে শীতকালেও পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ত্বক সতেজ রাখতে এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ আর্দ্রতা ধরে রাখতে দৈনিক প্রয়োজনীয় পানি পান করতে হবে।
ডিটক্স ওয়াটার গ্রহণ
সতেজ ত্বক এবং স্বাস্থ্যের জন্য ডিটক্স ওয়াটার অত্যন্ত সহায়ক। এতে শরীরের অপ্রয়োজনীয় টক্সিন বের হয়ে যায় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য ভাল থাকে। শীতের সময় পর্যাপ্ত ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন লেবু, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি খাওয়া ত্বককে সতেজ রাখতে সহায়ক।
উপসংহার
যখন শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব দেখা দেয়, তখন ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং শীতে আরও সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। এই ভিটামিনের অভাবে ত্বকের শুষ্কতা ছাড়াও জয়েন্টের ব্যথা, ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো সমস্যা দেখা দেয়। শীতে ত্বককে শুষ্ক হওয়া থেকে রক্ষা করতে এবং সুস্থ ও সতেজ রাখতে ভিটামিন সি যুক্ত খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন।