যদিও ঠাকুরগাঁও আয়তনে ছোট, এটি এমন এক জনপদ যেখানে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিবিড় শিকড়। বহু যুগ ধরে এখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাঁদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ও রীতিনীতি ধরে রেখেছেন। পাশাপাশি, ইতিহাসের বর্ণময় পালা বদলের সাক্ষী হিসেবে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসনের বিভিন্ন প্রতিফলনও দেখা যায় এখানে। ব্যস্ত জীবনযাপনের একঘেয়েমি কাটাতে আর মনের তৃষ্ণা মেটাতে বৈচিত্র্যের খোঁজে যে কেউ ঠাকুরগাঁও ঘুরে আসতে পারেন। প্রাকৃতিক শোভা ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যে ঠাকুরগাঁও এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার শহর।
শীতের প্রকৃতির আমেজ ও দর্শনীয় স্থানসমূহ
এখন হেমন্তকাল, কিন্তু উত্তরের এই জনপদে শীতের আমেজ এখনই লেগে গেছে। সকালের শিশিরে সেজে উঠেছে সবুজ ঘাসের ডগা, সূর্যের আলোয় তা যেন সোনার মতো ঝকঝকে। শীতের এই সময় প্রকৃতির মাধুর্য উপভোগের পাশাপাশি ঘুরে দেখতে পারেন অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। যেমন ২০০ বছরের প্রাচীন সূর্যপুরী আমগাছ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি, সাধারণ মানুষের জীবনবৈচিত্র্য তুলে ধরা লোকায়ন জাদুঘর এবং বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদ।
সূর্যপুরী আমগাছ – ইতিহাসের সাক্ষী
ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারী সীমান্তে অবস্থিত মণ্ডুমালা গ্রামে আছে একটি বিশেষ সূর্যপুরী আমগাছ। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে এটি যেন বটগাছ, কিন্তু এটি আসলে বিশাল এক আমগাছ। গাছটির শেকড়, ডাল, এবং পাতা এতই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে প্রকৃতির আপন খেয়ালে এটি ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটির ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য ও বিশালতা শুধু দেশি নয়, বিদেশি পর্যটকদেরও মুগ্ধ করে।
সূর্যপুরী আমগাছটি স্থানীয় সূর্যপুরী আমের জাত থেকে উদ্ভূত, যা খেতে সুস্বাদু ও রসালো। গাছটি প্রায় দুই বিঘা জমিজুড়ে বিস্তৃত, এবং তার উচ্চতা ৮০ থেকে ৯০ ফুটের কাছাকাছি। এর শাখা প্রশাখা, যা গাছের মূল থেকে তিন দিকে বের হয়ে গেছে, দেখতে অক্টোপাসের মত। গাছটির বয়স নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা মত আছে – কেউ বলেন ১৫০ বছর, আবার কেউ বলেন ২৫০ বছর। এত বছর পরেও গাছটি থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০০ থেকে ১২০ মণ আম উৎপন্ন হয়।
রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি – আধুনিক ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে রাণীশংকৈল উপজেলায় অবস্থিত মালদুয়ার জমিদার রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। রাজা টংকনাথের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন না; বরং তার বাবা বুদ্ধিনাথ চৌধুরী ছিলেন এক মন্দিরের সেবায়েত। নিঃসন্তান জমিদারের কাশীবাসের সময় বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারির মালিকানা পান এবং রাজবাড়িটি নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র টংকনাথ এই নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
১০ একর জমির ওপর স্থাপিত এই রাজবাড়িতে ঢুকতে হলে বিশাল এক সিংহদরজা পেরোতে হয়। লাল রঙের দালানটির স্থাপত্যে আধুনিকতার ছোঁয়ার সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান অলংকরণের ছাপ স্পষ্ট। এর সঙ্গে রাজবাড়ির আশেপাশে রয়েছে কাচারি বাড়ি, পুকুর এবং রাজবাড়ির কাছাকাছি রামচন্দ্র মন্দির।
লোকায়ন জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর – গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্ব আকচা গ্রামের নৈসর্গিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘লোকায়ন জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর’। এর প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান এই জাদুঘরের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, সংগ্রাম এবং সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণ করেছেন। জাদুঘরটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে এবং বর্তমানে এখানে কৃষক-খামারি, জেলে-তাঁতি এবং অন্যান্য খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার নানা উপকরণ প্রদর্শিত হয়।
জাদুঘরটির মূল আকর্ষণ হল ‘মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি’। এখানে ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র, পত্রিকার প্রতিবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত উপকরণসহ নানা ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, ও উৎসবের নানা উপকরণে সমৃদ্ধ ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গ্যালারি’ও এখানে আছে।
‘আঞ্চলিক ভাষা গ্যালারি’তে দেশের ৬৪টি জেলার আঞ্চলিক ভাষার রেকর্ড শোনা যায়। এ ছাড়া ‘নদী গ্যালারি’তে কাচের বোতলে সংরক্ষণ করা হয়েছে মরা ও বিলুপ্তপ্রায় নদীর পানি এবং নদী ও জনজীবনের নানা উপকরণ। সম্প্রতি এই জাদুঘরে বিজ্ঞান গ্যালারিও যুক্ত করা হয়েছে।
জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ – ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে জামালপুর গ্রামে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ। চুন, সুরকি ও ইটের তৈরি এই মসজিদের ভেতর–বাইরে অসাধারণ নকশায় শোভিত। মসজিদটি চারটি আলাদা অংশে বিভক্ত – প্রবেশপথ, মূল কক্ষ, বারান্দা, এবং উপরের উন্মুক্ত স্থান। প্রবেশপথের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে মূল কক্ষে পৌঁছানো যায়, যেখানে রয়েছে লতাপাতা ও ফুলের কারুকার্য।
ছোট বালিয়া জামে মসজিদ – গল্পের মসজিদ
ঠাকুরগাঁও সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রামে অবস্থিত ছোট বালিয়া জামে মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে ‘জিনের মসজিদ’ নামে পরিচিত। প্রচলিত রয়েছে, রাতের আঁধারে জিন-পরিরা এই মসজিদ নির্মাণ করেছিল কিন্তু ভোর হওয়ায় ছাদ-গম্বুজ নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে প্রায় ১০০ বছর পর স্থানীয়দের উদ্যোগে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ হয়। বর্তমানে এটি মুসল্লিদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নামাজের স্থান।
স্থানীয় জমিদার গুলমতি চৌধুরানীর উদ্যোগে এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী দৃষ্টিনন্দন। এটি প্রায় ৬২ ফুট দীর্ঘ এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত। ২০০৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ শুরু হয় এবং ২০১০ সাল থেকে এখানে মুসল্লিরা নামাজ আদায় শুরু করেন।
অন্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
ঠাকুরগাঁওয়ে দর্শনীয় স্থান শুধু এসবেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে আরও রয়েছে সদর উপজেলার ঢোলারহাট মন্দির, শালবাড়ি মসজিদ ও ইমামবাড়া, রাণীশংকৈল উপজেলার বাংলা গড়, জগদল রাজবাড়ি, বেলে পাথরের কূপ, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার গড়খাঁড়ি দুর্গ, পীরগঞ্জের ঐতিহাসিক রাজভিটা, সাগুনি রাবার ড্যাম এবং হরিপুরের রাজবাড়ি। প্রতিটি স্থাপনা ও স্থান পর্যটকদের মুগ্ধ করবে এবং ইতিহাসের এক একটি অংশের সঙ্গে পরিচিত করবে।
উত্তরের জনপদের আমন্ত্রণ
ব্যস্ত নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটাতে এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘুরে দেখতে ঠাকুরগাঁও হতে পারে একটি অসাধারণ গন্তব্য। স্থানীয়দের আতিথেয়তায় মোড়ানো এই জনপদে আপনিও পেতে পারেন মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রকৃতি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো একবার দেখলে আপনার মন সেইসব স্মৃতিতে ভরে উঠবে, যা কখনো ভোলার নয়। শীতের এই মৌসুমে ঠাকুরগাঁও-এর ঐতিহাসিক আর প্রাকৃতিক মেলবন্ধনে মুগ্ধ হতে আসুন।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন