রোজা যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই ভোজ্যতেলের বাজারে অসাধু চক্রের কারসাজি তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে, সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাজার থেকে এক প্রকার উধাও হয়ে গেছে। বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে কোম্পানিগুলো মিল পর্যায় থেকে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, যার ফলে ডিলাররা খুচরা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে তেলের দাম বাড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ক্রেতারা যথাযথ পরিমাণ তেল পাচ্ছেন না, ফলে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট আরও প্রকট হয়েছে। সয়াবিন তেল নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বিশ্ববাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম ১৮ মাসে সর্বোচ্চ
রাজধানীর বাজারগুলোতে সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। কয়েকদিন ধরেই এক লিটার ও দুই লিটারের বোতল বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না, এখন সেই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ক্রেতাদের জন্য এটি এক বিরাট ভোগান্তি তৈরি করেছে, কারণ বাজারে এই বোতলগুলোর সরবরাহ প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে।
বিক্রেতারা অভিযোগ করছেন, তাদের কাছে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ তেলই সরবরাহ করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। বাজারে এখন কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অন্য ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল প্রায় একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না।
কারওয়ান বাজারের এক মুদি দোকানি নোমান বলেন, “দুই সপ্তাহ ধরে চাহিদামতো তেল পাচ্ছি না। এর ফলে অন্যান্য পণ্যও বিক্রি করতে সমস্যা হচ্ছে। এটি মূলত দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোম্পানি ও ডিলাররা মিলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।”
তেল কিনতে আসা তোফায়েল জানান, “কয়েকটি দোকানে গিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাইনি। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও তারা বিক্রি করছে না। বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন কিনতে হচ্ছে, তবে সেটা বাড়তি দামে।”
আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের জন্য সরবরাহ কমেছে। বিশ্ববাজারে এক লিটারের তেলের দাম ১০ থেকে ১৩ টাকা বেড়ে গেছে, এবং এ কারণে দেশের বাজারে সরবরাহ কমে গেছে ২০ শতাংশের মতো।
এ বিষয়ে ভোক্তার নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল মন্তব্য করেন, “মূল্য সংযোজন কর কমানোসহ নানা সুবিধা দেওয়ার পরও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তেলের দাম কমানোর পরিবর্তে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনই কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এবারের রমজানে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
এতে উল্লেখযোগ্য যে, গত অক্টোবরে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে শুল্ক-কর দুই দফা কমানো হলেও, তার পরেও বাজারে তেলের দাম কমেনি বরং বেড়েছে। সুতরাং, সরকারের ঘোষিত শুল্ক-কর কমানোর সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ ভোক্তারা সঠিকভাবে উপকৃত হতে পারছেন না।
সয়াবিন তেলের দাম
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল খুচরা বাজারে ১৬৭-১৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, যা পূর্বে ছিল ১৫৭-১৬০ টাকা। একদিকে সয়াবিন তেলের সংকট, অন্যদিকে তেলের দাম বৃদ্ধি, সাধারণ ক্রেতাদের জন্য তা হয়ে উঠেছে এক নিত্যদিনের উদ্বেগের বিষয়। এর পাশাপাশি, পাম তেল ও রাইসব্রান তেলের দামও ব্যাপক বেড়েছে।
মধ্য অক্টোবরের দিকে সরকার পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছে, এবং তেল উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে এই ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তেলের দাম তাতে মোটেও কমেনি। মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৫ টাকা, এবং বোতলজাত তেলের দাম ১৬৭-১৭০ টাকা হয়ে গেছে। পাম তেল এবং রাইসব্রান তেলের দামও প্রতি লিটার ৬ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ডালের বাজারে নৈরাজ্য চরমে, কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা
বাজার সংকট
এই পরিস্থিতির কারণে খুচরা বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। মুদি বিক্রেতারা বলছেন, ডিলাররা প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। একজন মুদি বিক্রেতা, মো. তুহিন জানিয়েছেন, ১৫ দিন আগেও তিনি পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৭৯০-৮০০ টাকায় কিনে ৮১৮ টাকায় বিক্রি করতেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি তা পাচ্ছেন না, এবং দামও বেড়েছে। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত তেলও ১৬৫-১৬৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
বিভিন্ন তেল কোম্পানির ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সয়াবিন তেল সরবরাহ কমিয়েছে, যাতে রোজা শুরুর আগেই তেলের দাম বাড়ানো যায় এবং তারা বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে পারে। এক ডিলার জানান, তারা যেখানে ১০০ কার্টন তেলের চাহিদা দেয়, সেখানে কোম্পানি মাত্র ২০-৩০ কার্টন তেল সরবরাহ করছে।
রোজা শুরু আগে বাজার সিন্ডিকেট
রোজা শুরুর আগেই বাজারে এ ধরনের কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হওয়া ভোক্তাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাহকরা বলছেন, প্রতি বছর রমজানে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর এই পুরোনো সিন্ডিকেটের কর্মকাণ্ড এবারও পুনরায় শুরু হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, রোজা আসার পর তেলের দাম আরও বাড়বে এবং তারা বাড়তি দামেই তেল কিনতে বাধ্য হবেন।
আরও পড়ুন: এসএমএসে দাম চালাচালি করতে পারছে না কোম্পানিগুলো, ডিমের বাজারে স্বস্তি
এদিকে, পাম তেলের দামও অনেকটা বেড়েছে। খুচরা বাজারে পাম তেলের দাম ১৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১৫০ টাকা। পাম অয়েল সুপারও ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৫৪ টাকা। একইভাবে, রাইসব্রান তেলের দামও বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার রাইসব্রান তেল ২০০-২১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৮৫-১৯৫ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলজাত রাইসব্রান তেল ৯৮০-১০৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগের তুলনায় ১০০-১৫০ টাকা বেশি।
বিশ্বব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন এবং পাম তেলের দাম কমেছে। তবে দেশের বাজারে এই দাম বেড়েছে, যা ভোক্তাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, আমদানির খরচ কমলেও দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম কমে ১ হাজার ৪৪ ডলারে দাঁড়ালেও, দেশের বাজারে তা ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে,
আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম বাড়ানোর কারণে অন্যান্য ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে। তারা পরামর্শ দিয়েছে, পাম ও সয়াবিন তেলের ওপর ভ্যাট কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা প্রয়োজন, যাতে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আরও পড়ুন: ডিমের দাম ডজনে কমেছে ২৫ টাকা- ক্রেতাদের মাঝে স্বস্তি
এদিকে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের বিষয়ে তদারকি অব্যাহত আছে এবং কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি পাওয়া গেলে আইনের আওতায় আনা হবে।
সয়াবিন তেল নিয়ে তেলবাজির এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন, যাতে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং সয়াবিন ও পাম তেলের কৃত্রিম সংকট বন্ধ করা সম্ভব হয়।
2 thoughts on “বাজার থেকে হঠাৎ উধাও হচ্ছে সয়াবিন তেল: দাম আরও বাড়ার শঙ্কা”