অস্থির বাংলাদেশ সচিবালয়: কাজের চেয়ে আলোচনা বেশি

গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর, সচিবালয়ের পরিস্থিতি ছিল অস্থির। সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই এই প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল উত্তাল। বিক্ষোভ, অবরোধ, অনশন এবং বিশৃঙ্খলা সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সচিবালয়ে সরকারের কাজের চেয়ে বেশি ছিল আলোচনা, মতবিনিময় এবং আন্দোলন। সরকার কিছুটা হিমশিম খেলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়, তবে এখনো বাংলাদেশ সচিবালয় এর সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা এসে দাঁড়ায়, যারা তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রকাশ করে।

২০১৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকারের মধ্যে ২৪ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে কাজ চলছে। সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ সচিবালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা পুরো ১০০ দিনের অধিকাংশ সময় ধরে চলতে থাকে।

বাংলাদেশ সচিবালয়-এ অস্থিরতা

সরকারের ১০০ দিনের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অস্থিরতার মধ্যে কাটান। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নিরাপত্তার কারণে সচিবালয়ে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলেও, বিক্ষোভ এবং আন্দোলন থামেনি। নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিনিয়ত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু জনগণের ক্ষোভ থামানো সম্ভব হয়নি।

সরকারের কাজের চেয়ে সচিবালয়ে আলোচনাই ছিল বেশি। কর্মচারীরা বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, এবং সরকারের প্রতি নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সরকারের নৌ-পরিবহণ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, জানান যে, ১৫ বছরের বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে জমে ছিল, তবে এখন তারা তা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। অনেকের দাবি ছিল যে, দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সরকার দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

পদোন্নতি ও বদলি

১১ আগস্ট, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কার্যদিবসেই সচিবালয়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল পদোন্নতি, বদলি ও পদায়ন। প্রতিদিন কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান করতেন, কিছু চাইতে বা তাদের দাবি আদায় করতে। এ সময় বিসিএস ক্যাডার থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত সবাই একত্রিত হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। দিন দিন এই আন্দোলন ব্যাপক হয়ে ওঠে এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

পাঁচ দফা দাবি

১১ নভেম্বর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের সামনে তাদের পাঁচ দফা দাবি নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়। পুলিশ, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী সচিবালয়ে নিরাপত্তা জোরদার করে। শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি একদিনের জন্য সচিবালয়ের কাজকর্মে প্রভাব ফেলেছিল। সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়, এবং সচিবালয়ের কর্মচারীরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অফিস থেকে বের হতে সক্ষম হন।

বাংলাদেশ সচিবালয়
বাংলাদেশ সচিবালয়

পরীক্ষার্থীদের প্রতিবাদ

২৩ অক্টোবর, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের দাবি নিয়ে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সচিবালয়ের একাধিক গেটে ঢুকে প্রতিবাদ করতে থাকে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে ৫৪ জনকে আটক করে এবং ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। প্রশাসন ওই দিন সচিবালয়ের সমস্ত প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়, এবং কর্মকর্তারা একদম ভেতরে আটকে পড়েন।

এর আগে, ২০ আগস্ট, এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার পুনঃমূল্যায়ন ও সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফল প্রকাশের দাবি নিয়ে সচিবালয়ে অবস্থান নেন। তাদের দাবি মেনে নেওয়ার পর, আন্দোলন থামল এবং সচিবালয়ের পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হলো।

ডিসি নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ

৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর, ডিসি নিয়োগের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের রুমে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিনটি উপদেষ্টা সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যা তদন্ত করে এবং ডিসি নিয়োগে ঘুসের অভিযোগ মিথ্যা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

বিক্ষোভ ও অরাজকতা

বাংলাদেশ সচিবালয়ের বাইরে এবং ভেতরে আন্দোলন ও বিক্ষোভের ঘটনা চলতেই থাকে। ১৮ আগস্ট, চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যরা তাদের বিক্ষোভ প্রকাশ করে, এবং একই দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তারা তাদের দাবি নিয়ে বিক্ষোভে শামিল হয়। সচিবালয়ে এসব আন্দোলনের কারণে পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠে, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়।

আনসার সদস্যদের আন্দোলন

আগস্ট মাসে, ২৩ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত আনসার সদস্যরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন এবং রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাদের দাবির জন্য সচিবালয়ের কর্মচারীরা প্রবেশ করতে পারেনি। পরবর্তীতে, ২৬ আগস্ট রাতে এই সংঘর্ষে আনসার সদস্যদের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ে, এবং পুলিশের সহায়তায় প্রায় ৪০০ আনসার সদস্যকে আটক করা হয়। এই ৩ দিন বাংলাদেশ সচিবালয়ের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে।

পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ

এমন সব আন্দোলন, বিক্ষোভ, এবং সংঘর্ষের মাঝেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায়, সচিবালয়ের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হলেও তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে, এসব আন্দোলন ও প্রতিবাদ বাংলাদেশের সচিবালয়ের কার্যক্রমে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য পরিস্থিতি।

এতসব প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের মাঝে সরকার সচিবালয়ের পরিবেশ ও কার্যক্রম ঠিক রাখতে চেষ্টা করেছে। দেশের বৃহত্তম প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ওপর সরকারের দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই ১০০ দিনে সরকারের অনেক অর্জন ছিল।

উপসংহার

বাংলাদেশ সচিবালয় দীর্ঘদিনের অস্থিরতার পর, এখন বেশিরভাগ সময় শান্তিপূর্ণ। তবে, সরকারকে বারবার আন্দোলন এবং বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সরকারের অর্জনগুলো যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি জনগণের ক্ষোভ এবং দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে আরো উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে, বাংলাদেশ সচিবালয় এখন শান্ত অবস্থায় রয়েছে এবং সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

Juger Alo Google News যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

2 thoughts on “অস্থির বাংলাদেশ সচিবালয়: কাজের চেয়ে আলোচনা বেশি”

Leave a Comment