অনলাইন ক্যাসিনো সার্চে শীর্ষে রংপুর, রাজশাহী দ্বিতীয়: তরুণদের চোখে স্বপ্ন, বাস্তবে নিঃস্ব হওয়ার ছক
রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন—এই স্বপ্নে ভেসে এখন অনেক তরুণ ডুবে যাচ্ছেন এক অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক খেলায়, যার নাম অনলাইন ক্যাসিনো। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ জগতের দিকে দেশের সবচেয়ে বেশি তরুণ ঝুঁকেছেন রংপুর বিভাগ থেকে। গুগল ট্রেন্ডসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রংপুর বিভাগ থেকে অনলাইন ক্যাসিনো সংক্রান্ত বিষয় সবচেয়ে বেশি সার্চ করা হয়েছে। স্কোর ১০০-এর মধ্যে ১০০—মানে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা এখানেই। রাজশাহী রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, স্কোর ৪৬।
অনলাইন জুয়ার এ প্রবণতা শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি সমাজের গভীর এক সমস্যার প্রতিচ্ছবি। শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও বেকার তরুণরা এখন ‘বাবু৮৮’ সহ অন্যান্য ক্যাসিনো প্ল্যাটফর্মে নিজেদের ভবিষ্যৎ বাজি ধরছেন।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
গুগল ট্রেন্ডস কীভাবে জানাল তরুণদের পছন্দ
গুগল ট্রেন্ডস একটি ফ্রি টুল, যা গুগলে করা সার্চের পরিমাণ ও জনপ্রিয়তা বিশ্লেষণ করে। এটি ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোরে দেখায়, কোন বিষয়টি কোন অঞ্চলে কতটা বেশি সার্চ হচ্ছে। গুগল এই ডেটা দিয়ে বোঝায়, কোন অঞ্চলের মানুষ কী বিষয়ে বেশি আগ্রহী।
রংপুর বিভাগ যেখানে এই সার্চে সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জন করেছে, তা দেখে অভিজ্ঞরাও অবাক। প্রথম আলোর এসইও হেড মাজহারুল হক জানান, ‘‘এই ট্রেন্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে রংপুর ও রাজশাহীর শিক্ষার্থী ও তরুণরা এখন এই অনলাইন জুয়ায় বেশি আকৃষ্ট। পরিবার ও প্রশাসনের এখনই এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।’’
আরও পড়ুন


অনলাইন ক্যাসিনো কী
ক্যাসিনো হলো একধরনের জুয়ার ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের গেম খেলতে পারে এবং জিতলে মূল টাকাসহ লাভ পায়, হারলে পুরো টাকা খোয়া যায়। সাধারণত ক্যাসিনো হোটেল, বার, রিসোর্ট বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হয়।
অনলাইন ক্যাসিনো হলো ডিজিটাল মাধ্যম, যেখানে মানুষ ঘরে বসেই বিভিন্ন ক্যাসিনো গেম খেলতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘বাবু৮৮’। এ ছাড়া অন্যান্য অনলাইন ক্যাসিনো সাইট রয়েছে, যা মূলত বাজির মাধ্যমে টাকা জেতার সুযোগ করে দেয় এবং হারলে পুরো নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। এটা নিষিদ্ধ।
আরো পড়ুন: ২৪০ টাকা ফ্রী বিকাশ পেমেন্ট – সত্যিটা কী? অফার নেই, কিন্তু ইনকামের সুযোগ আছে!
কাদের মধ্যে বেশি ঝোঁক?
তথ্যমতে, ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেই অনলাইন ক্যাসিনোর প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে শিক্ষার্থী, চাকরি খুঁজছেন এমন তরুণ এবং কিছু কর্মজীবী যারা হয়তো জীবনে দ্রুত সাফল্য পেতে চাচ্ছেন।
রংপুরের তরিকুল ইসলাম, একজন স্থানীয় এসইও বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘রংপুরে আমি এমন অনেক তরুণকে চিনি যারা এখন অনলাইন ক্যাসিনো নিয়ে দিব্যি ব্যস্ত। আগে তারা ইন্টারনেটের নাম পর্যন্ত জানত না, এখন তারা ক্যাসিনোর নিয়ম জানে।’’ তাঁর কথায়, এই প্রবণতা যেন এক নীরব বিপদ। ‘‘তারা জানেই না, তারা কোন পথে হাঁটছে।’’
অনলাইন জুয়ার জনপ্রিয়তা কেন বাড়ছে?
২০১৯ সালে ঢাকার কিছু অবৈধ ক্যাসিনোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালানোর পর থেকেই এই বিষয়ে মানুষের কৌতূহল বাড়তে শুরু করে। তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন, মোবাইল অ্যাপসের সহজলভ্যতা, আর পেমেন্ট সিস্টেমের সহজতা—সব মিলিয়ে তরুণদের জন্য এক মোহময় জগৎ তৈরি করেছে।
কেউ হয়তো ছোট্ট একটা বাজিতে ৫০০ টাকা জিতলেন—সেই আনন্দে আবার হাজার টাকা হারালেন। ঠিক এখানেই শুরু হয় আসক্তির যাত্রা।
৫০ লাখ মানুষ জড়িত, আইনি পদক্ষেপ নেই!
ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত। অথচ কার্যকর কোনো আইনি পদক্ষেপ না থাকায় এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। সাইটগুলোর বেশিরভাগ বিদেশি সার্ভার থেকে পরিচালিত হয়, আর পেমেন্টও হয় বিকাশ, নগদ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা কখনো কখনো ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমেও।
এই লেনদেন পদ্ধতি অনেক সময় প্রতারণার ফাঁদও হতে পারে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মানসিক বিপর্যয়
অনলাইন জুয়ায় কেউ কেউ লক্ষ টাকা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের সম্পদ বিক্রি করে জুয়ায় হারিয়েছেন অনেক তরুণ। কেউ কেউ হতাশায় ডুবে গেছেন, আবার কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
বাবার ছোট ব্যবসার টাকা নিয়ে এক তরুণ বাবু৮৮-তে বাজি ধরে সব হারিয়ে এখন আত্মগোপনে। এমন শত গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে রংপুর ও আশেপাশের এলাকায়।
ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ সংকেত
এসব ঘটনা নিছক ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি সামাজিক ব্যাধির চেহারা নিচ্ছে। গ্রামের তরুণেরা, যারা আগে হোস্টেল লাইফ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি—এসব নিয়ে ভাবতো, এখন তারা ভাবছে অনলাইন ক্যাসিনোতে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে সামাজিক স্থিতিশীলতা, পরিবারে অশান্তি এবং অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।


তরুণদের সচেতন করতে হবে এখনই
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বনানীতে এক আলোচনায় তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলেন, এখন তরুণদের জন্য অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া অপরিহার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীম আল মামুন বলেন, ‘‘অনলাইনের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি ঝুঁকিও আছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’’
টিকটক ও জাগো ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত সংলাপে প্রকল্প ব্যবস্থাপক তানভীর চৌধুরী বলেন, ‘‘তরুণদের শুধু নিষেধ করলে চলবে না, তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে হবে।’’
সমাধানের পথ কী?
এই সমস্যা ঠেকাতে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—
- সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কর্মশালা এবং ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি।
- অনলাইন পেমেন্টে নিয়ন্ত্রণ: যেসব মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে, সেগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো দরকার।
- আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ: অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার।
- মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র: আসক্তদের জন্য পরামর্শ ও মানসিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
শেষ কথা
রংপুর এখন ক্যাসিনো সার্চে দেশের শীর্ষে। রাজশাহী তার পেছনেই। এই তথ্য একদিকে যেমন উদ্বেগজনক, অন্যদিকে এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে তরুণদের এক বড় অংশ ধ্বংসের পথে হাঁটছে। এখনই যদি পরিবার, সমাজ এবং প্রশাসন একসঙ্গে কাজ না করে, তবে খুব দেরি হয়ে যাবে।
রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্নের ফাঁদে পা দিয়ে তরুণরা যেন নিজের ভবিষ্যৎ না হারায়—এটাই এখন আমাদের সকলের চাওয়া হওয়া উচিত।