ইসলামে বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম | বন্টন আইন বাংলাদেশ ২০২৫

আপনার বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে যেনো এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। একসময় যে ভাই-বোনেরা একসাথে খেলেছেন, হাসি-মজায় কাটিয়েছেন, আজ তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বাবার রেখে যাওয়া জমি-সম্পত্তিকে ঘিরে। উত্তরাধিকার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, তর্ক-বিতর্ক, এমনকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে যায়— বাংলাদেশে এ যেন এক নিত্যদিনের দৃশ্য।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

কিন্তু প্রশ্ন হলো ❓ এই কলহের আসল কারণ কী?
➡️ কারণ একটাই— ইসলামী শরিয়াহ ও দেশের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উত্তরাধিকার আইনকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“উত্তরাধিকার আইন শিখো এবং অন্যকে শেখাও, কেননা এটি অর্ধেক জ্ঞান।” (ইবনে মাজাহ)

তাহলে বুঝতেই পারছেন, “বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম” জানা শুধু জ্ঞানের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য এটি ফরজ ইবাদতের সমান।

এই Comprehensive Guide-এ আমরা ধাপে ধাপে জানবো—

  • কুরআন-হাদিসে নির্ধারিত উত্তরাধিকার বন্টন,
  • বাংলাদেশের ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে বন্টন আইন,
  • এবং বাস্তব জীবনের সহজ উদাহরণ ও টিপস।

আপনার অধিকার জানুন ✅, পরিবারের শান্তি রক্ষা করুন ✅, এবং ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে সঠিক তথ্য জানুন। তো দেরি কেন? চলুন শুরু করি— ✨

আরো পড়ুন: বসে না থেকে ত্রই Apps দিয়ে 300 টাকা ইনকাম করুন- কাজ করা খুব সোজা

Table of Contents

মিরাস বা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন: মৌলিক ধারণা

সম্পত্তি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ পরিষ্কারভাবে জানা দরকার। এগুলো না বুঝলে পুরো বিষয়টাই ঝাপসা মনে হবে। তাই আসুন একে একে সহজভাবে বুঝে নেই।

✧ মিরাস কী?

মিরাস একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো উত্তরাধিকার (inheritance)
ইসলামী শরিয়াহতে যে বিশেষ শাখায় মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি কীভাবে বণ্টন হবে তা নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়, তাকে বলা হয় “ইলমুল মিরাস” বা ইসলামী উত্তরাধিকার আইন

➡️ এটি একটি সুনির্দিষ্ট ও গণিতভিত্তিক আইন। কারও ইচ্ছা, আবেগ বা চাপের ভিত্তিতে এখানে পরিবর্তন আনা যায় না। অর্থাৎ— আল্লাহ যেভাবে নির্ধারণ করেছেন, সেভাবেই ভাগাভাগি করতে হবে।

✧ ফারায়েজ (ফরজ অংশ)

ফারায়েজ শব্দটি এসেছে “ফরজ” থেকে, যার মানে হলো বাধ্যতামূলক দায়িত্ব
কুরআন ও হাদিসে যেসব ব্যক্তির অংশ সরাসরি নির্ধারিত আছে, তাদের অংশকেই ফারায়েজ বলা হয়।

উদাহরণস্বরূপ—

  • স্ত্রী
  • কন্যা
  • মা
  • বাবা

➡️ এদের নির্ধারিত অংশ কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না। এটি চিরস্থায়ী ও বাধ্যতামূলক।

✧ আসাবা (অবশিষ্টাংশের উত্তরাধিকারী)

ফারায়েজভুক্ত উত্তরাধিকারীরা তাদের অংশ নেয়ার পর যদি সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে, তখন সেই অবশিষ্টাংশের অধিকারীরা হলেন আসাবা

➡️ সাধারণত পুরুষ আত্মীয়রা আসাবা হয়ে থাকেন, যেমন—

  • ছেলে
  • ভাই
  • চাচা
  • ভাতিজা

একজন ব্যক্তি একইসাথে ফারায়েজভুক্ত এবং আসাবা দুটো ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন— ছেলে:

  • বাবার সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশও পাবে,
  • আবার অবশিষ্ট অংশ থাকলেও সেটারও দাবিদার হবে।

✧ ফতুয়া বা দানযোগ্য সম্পত্তি

ফতুয়া বলতে বোঝায় জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি থেকে কাউকে দান করে যাওয়া। তবে ইসলাম এখানে কিছু সীমারেখা বেঁধে দিয়েছে—

  • মৃত্যুশয্যায় (মারাজুল মাউত) থাকাকালীন দান সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
  • কোনো একজন সন্তানকে অন্যদের চেয়ে বেশি দান করা যাবে না (যদি না অন্য সন্তানরা স্বেচ্ছায় রাজি হয়)।
  • বৈধ উত্তরাধিকারীর নামে দান করা যাবে না, যদি অন্য উত্তরাধিকারীরা এতে অসম্মত হয়।

➡️ অর্থাৎ ইসলাম চায় না যে দান বা উইলের মাধ্যমে কারও প্রাপ্য অংশ কেড়ে নেয়া হোক।

সংক্ষেপে:

  • মিরাস = উত্তরাধিকার আইন
  • ফারায়েজ = কুরআনে নির্ধারিত বাধ্যতামূলক অংশ
  • আসাবা = অবশিষ্টাংশের উত্তরাধিকারী
  • ফতুয়া = জীবিত অবস্থায় দান, যার উপর সীমাবদ্ধতা আছে

আরা পড়ুন: মনিটাইজেশনের ঝামেলা ছাড়াই ফেসবুক থেকে ইনকামের ৫টা নতুন উপায়- যা সবাই মিস করছে

বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বাবার সম্পত্তিতে সন্তানদের অংশ

সন্তানরা হলো বাবার সম্পত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান উত্তরাধিকারী। কুরআনের সূরা নিসা’য় (আয়াত: ১১) অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তাদের অংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের এই দিকটি খুবই সুবিন্যস্ত এবং গণিতসম্মত। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—

ছেলে সন্তানের অংশ: কেন পায় দ্বিগুণ?

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে— ছেলে কেন মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ পায়? ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য করেনি, বরং দায়িত্বের ভিত্তিতে ভিন্নতা নির্ধারণ করেছে।

➡️ কুরআনের নির্দেশ:
“আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে নির্দেশ দেন: পুত্রের অংশ হবে দুই কন্যার সমান।” (সূরা নিসা: ১১)

➡️ যৌক্তিক কারণসমূহ:

  • পুরুষকে পরিবারের সকল নারী সদস্যের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
  • মহরানা, বাসস্থান, খাবার, পোশাকসহ যাবতীয় ব্যয়ভার পুরুষ বহন করে।
  • কন্যা সন্তান বিবাহিত হলে তার আর্থিক দায়িত্ব তার স্বামীর উপর বর্তায়।

অতএব, বেশি দায়িত্বের বিনিময়ে বেশি অংশ প্রদান ইসলামি ন্যায়বিচারেরই প্রতিফলন।

মেয়ে সন্তানের অধিকার: ইসলাম যে অধিকার দিয়েছে

ইসলাম মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে, যা তৎকালীন আরব সমাজে ছিল একেবারেই বিপ্লবাত্মক।

  • একজন মাত্র কন্যা থাকলে: সম্পত্তির অর্ধেক (১/২) অংশ সে পাবে।
  • দুই বা ততোধিক কন্যা থাকলে: তারা মিলে সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) অংশ পাবে।

ছেলে-মেয়ে উভয় থাকলে বণ্টন পদ্ধতি (সহজ উদাহরণ)

উত্তরাধিকারীসম্পর্কঅংশের অনুপাতপ্রাপ্ত অর্থ (টাকা)
ছেলেআসাবা২ অংশ২,০০,০০০ টাকা
মেয়েফরজ অংশগ্রহণকারী১ অংশ১,০০,০০০ টাকা
মোট৩ অংশ৩,০০,০০০ টাকা

ক্যালকুলেশন:
মোট অংশ = ২ (ছেলে) + ১ (মেয়ে) = ৩ অংশ।
প্রতি অংশের মূল্য = ৩,০০,০০০ ÷ ৩ = ১,০০,০০০ টাকা।
➡ ছেলে পেল ২ × ১,০০,০০০ = ২,০০,০০০ টাকা।
➡ মেয়ে পেল ১ × ১,০০,০০০ = ১,০০,০০০ টাকা।

শুধুমাত্র কন্যা সন্তান থাকলে কী হয়?

  • একটি মাত্র কন্যা থাকলে: সে অর্ধেক (১/২) অংশ পাবে। বাকি অর্ধেক অংশ বাবার নিকটতম পুরুষ আত্মীয় (আসাবা) যেমন ভাই, চাচা ইত্যাদি পাবেন।
  • দুই বা ততোধিক কন্যা থাকলে: তারা সবাই মিলে দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) অংশ পাবে। অবশিষ্ট অংশ (১/৩) বাবার নিকটতম পুরুষ আত্মীয়দের মাঝে বণ্টিত হবে।

আরো পড়ুন: শূন্য থেকে ইনকাম শুরু করুন—ঘরে বসে অনলাইনে আয়ের ১০টি পরীক্ষিত উপায়

বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক আইন ও আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারের জন্য বাবার সম্পত্তি ভাগ-বণ্টনের নিয়ম মূলত ইসলামী শরিয়াহ অনুসারে পরিচালিত হয়। এখানে শরিয়াহর বিধান এবং দেশীয় আইনের সমন্বয়ে একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা আদালতগুলোও অনুসরণ করে।

বাংলাদেশের উত্তরাধিকার আইন কী?

মুসলিম পরিবারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত আইনগুলো প্রযোজ্য:

  • মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১
  • Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937

এই আইনগুলোই প্রতিষ্ঠা করে যে, মুসলিমদের সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলার রায়ে এই নীতিকে বহুবার সমর্থন ও পুনঃনিশ্চিত করেছে।

১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন বনাম বর্তমান আইন

অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে Indian Succession Act, 1925 এর কথা উল্লেখ করেন। তবে—

  • এই আইন কেবল অমুসলিমদের (যেমন খ্রিস্টান সম্প্রদায়) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
  • মুসলিমদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়।

অতএব, বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম জানতে হলে মুসলিম পারিবারিক আইনকেই অনুসরণ করতে হবে।

উত্তরাধিকার আইনের ধারা ৬৯ ও ৩৭ – সরল ব্যাখ্যা

ইন্টারনেটে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তাই বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার:

  • ধারা ৩৭: এটি মূলত Hindu Undivided Family (HUF) সম্পর্কিত বিধান। মুসলিম উত্তরাধিকারের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
  • ধারা ৬৯: এটি Contract Act, 1872 এর অধীনে একটি ধারা, যা চুক্তি ও দায়-দায়িত্ব নিষ্পত্তির বিষয়ে। এরও উত্তরাধিকার বণ্টনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক নেই।

➡️ বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কোনো আলাদা “ধারা ৩৭” বা “ধারা ৬৯” নেই যা অংশ নির্ধারণ করে। তাই নির্ভরযোগ্য ইসলামি আইন ও কোর্টের রায়কেই অনুসরণ করতে হবে।

আদালত কীভাবে মামলা নিষ্পত্তি করে?

সম্পত্তি বণ্টন সংক্রান্ত মামলা হলে আদালত মূলত নিচের বিষয়গুলো যাচাই করে:

  1. মৃত ব্যক্তির সকল বৈধ উত্তরাধিকারী কারা।
  2. তাদের প্রত্যেকের শরিয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত অংশ কত।
  3. কোনো ওসিয়ত/উইল আছে কিনা (যা এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে হবে)।
  4. প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারীরা চাইলে আদালতের বাইরে আপস করতে পারবেন, তবে শরিয়াহর ফরজ অংশ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।

একটি জনপ্রিয় কেস স্টাডি

একটি মামলায় (বাদী বনাম বিবাদী – নাম পরিবর্তিত) হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে বলেন:

“একজন কন্যা সন্তানকে তার শরিয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত অংশ থেকে বঞ্চিত করা আইনত ও ধর্মীয়ভাবে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।”

এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের আদালত শরিয়াহর মূলনীতি মেনে চলে এবং ন্যায্য উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেয়।

আরো পড়ুন: আপনি জানেন কি? ফেসবুকে কত ফলোয়ার হলে টাকা আয় করা সম্ভব — ৯৯% মানুষই জানে না!

বাবার সম্পত্তি বন্টন ক্যালকুলেটর: একটি সহজ পদ্ধতি

জটিল ভগ্নাংশ আর অংক কষে হিসাব করার ঝামেলা থেকে বাঁচতে এখন অনলাইনে পাওয়া যায় ইসলামিক ইনহেরিটেন্স ক্যালকুলেটর। এটি ব্যবহার করে খুব দ্রুত বাবার সম্পত্তি বণ্টনের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।

✅ কিভাবে ব্যবহার করবেন?

১. প্রথমে একটি বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটে যান (যেমন Islamic Inheritance Calculator – উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ)।
2. মৃত ব্যক্তির পরিবারে কে কে জীবিত আছেন তা সিলেক্ট করুন (যেমন: স্ত্রী, ১ ছেলে, ২ মেয়ে, পিতা, মাতা)।
3. Calculate বাটনে ক্লিক করুন।
4. ক্যালকুলেটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যেকের শরয়ী অংশ শতকরা হার ও ভগ্নাংশ আকারে দেখিয়ে দেবে।

⛔ সতর্কতা

  • ক্যালকুলেটর কেবল একটি প্রাথমিক গাইড মাত্র।
  • এটি সফটওয়্যার নির্ভর হওয়ায় অনেক সময় জটিল পারিবারিক পরিস্থিতি (যেমন একাধিক স্ত্রী, সৎভাই-বোন, বিভিন্ন স্তরের উত্তরাধিকারী) সঠিকভাবে গণনা করতে পারে না।
  • তাই, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ আলেম (ইসলামী স্কলার) এবং একজন যোগ্য আইনজীবীর পরামর্শ নিতে হবে।
  • কখনোই ক্যালকুলেটরের ফলাফলকে চূড়ান্ত মনে করবেন না।

সম্পত্তি ভাগ করার সর্বোত্তম ও বিরোধ-এড়ানোর উপায়

সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে পরিবার ভেঙে যায়, সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং অনেক সময় বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে। তাই বিরোধ মেটানোর চেয়ে আগে থেকেই প্রতিরোধ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো—

✔️ জীবিত অবস্থায়ই উইল (ওসিয়ত) করার ইসলামী বিধান

  • ইসলাম জীবদ্দশায় নিজের সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পর্যন্ত ওসিয়ত (Will) করার অনুমতি দিয়েছে।
  • এই অংশ আপনি গরিব আত্মীয়, অসহায় মানুষ অথবা কোনো সামাজিক/ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারেন।
  • সতর্কতা: বৈধ উত্তরাধিকারীদের (যেমন ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী) জন্য ওসিয়ত করা জায়েজ নয়, যদি না অন্য উত্তরাধিকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে রাজি থাকে।

✔️ লিখিত চুক্তি ও রেজিস্ট্রেশন করার গুরুত্ব

  • বাবা মারা যাওয়ার পর যদি উত্তরাধিকারীরা আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছান, তাহলে একটি লিখিত চুক্তি (Deed of Partition) তৈরি করতে হবে।
  • এই চুক্তি অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে, যাতে এটি আইনের চোখে বৈধ থাকে।
  • রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কাগজপত্র ভবিষ্যতে আদালতে কার্যকর নাও হতে পারে।
  • একটি রেজিস্টার্ড চুক্তি ভবিষ্যতের যেকোনো বিরোধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইনগত প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।

✔️ পারিবারিক সমঝোতা: আদালতের বাইরে সমাধান

  • পরিবারের মধ্যে কোনো মতবিরোধ দেখা দিলে প্রথমেই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের মধ্যস্থতা (mediation) গ্রহণ করুন।
  • স্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তি বা আলেমের সাহায্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজুন।
  • মনে রাখবেন, সম্পত্তি চলে যাবে, কিন্তু সম্পর্কের মূল্য অমূল্য। আত্মীয়তার বন্ধন টিকিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় সম্পদ।

➡️ এভাবে ইসলামি নির্দেশনা, লিখিত নথিভুক্তি এবং পারিবারিক সমঝোতা বজায় রাখলে সম্পত্তি বণ্টন হবে শান্তিপূর্ণভাবে এবং বিরোধ এড়ানো সম্ভব হবে।

আরো পড়ুন: অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি! মোবাইল দিয়েই ইনভেস্ট ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রতিদিন ২-৩ ডলার ইনকাম — নতুনদের জন্য সেরা সুযোগ

বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম
বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম

মানুষ যেসব সাধারণ ভুল ধারণা পোষণ করে (মিথ Vs সত্য)

ইসলামে বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম নিয়ে সমাজে অসংখ্য ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এর ফলে অযথা দ্বন্দ্ব, বঞ্চনা ও অন্যায় বণ্টন ঘটে। নিচে কিছু প্রচলিত মিথ বনাম সত্য তুলে ধরা হলো—

মিথ ১: বিবাহিত মেয়ের সম্পত্তিতে কোন অধিকার নেই।
সত্য: ইসলাম মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে, বিয়ে তা হরণ করে না। বিবাহিত-অবিবাহিত—যে অবস্থায়ই থাকুক, মেয়ে তার বাবার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকারী।

মিথ ২: বাবা যদি মৌখিক প্রতিশ্রুতি (oral promise) দেন, তা আইনত বহাল থাকে।
সত্য: জমি-সম্পত্তির ক্ষেত্রে লিখিত, স্ট্যাম্পযুক্ত ও রেজিস্ট্রিকৃত দলিলই একমাত্র প্রমাণ। মৌখিক কথার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

মিথ ৩: বড় ছেলে বা পরিবারের কর্তা হিসেবে বেশি অংশ পায়।
সত্য: ইসলামী আইনে সকল ছেলের অংশ সমান। বড় বা ছোট ছেলে—সবার ভাগ সমান (মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ)।

মিথ ৪: মা তার ছেলেদের পক্ষে মেয়েকে বঞ্চিত করতে পারেন।
সত্য: মা সন্তানের সম্পত্তি বণ্টনে কোনো পরিবর্তন করতে পারেন না। কুরআন-সুন্নাহতে নির্ধারিত ভাগই চূড়ান্ত।

মিথ ৫: বাবা জীবিত অবস্থায় চাইলে পুরো সম্পত্তি এক সন্তানকে লিখে দিতে পারেন।
সত্য: ইসলাম এটি অনুমোদন করে না। জীবিত অবস্থায় অন্যায়ভাবে এক সন্তানকে বেশি দিলে তা হারাম ও বাতিলযোগ্য।

মিথ ৬: মেয়ে যদি বিদেশে থাকে বা বাবার যত্ন না নেয়, তবে তার সম্পত্তিতে অধিকার নেই।
সত্য: ইসলামে যত্ন নেওয়া বা অবস্থান কোনো শর্ত নয়। কেবল উত্তরাধিকারী হওয়াই সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার শর্ত।

মিথ ৭: মৃত ব্যক্তির ঋণ বা জানাজা খরচ না দিয়েই উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি ভাগ করে নিতে পারে।
সত্য: ইসলামে প্রথমেই মৃতের ঋণ, জানাজা ও দাফনের খরচ পরিশোধ করতে হবে। এরপরই সম্পত্তি ভাগ হবে।

মিথ ৮: মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কেবল গ্রামে প্রযোজ্য, শহরে আদালতের নিয়মে ভাগ হয়।
সত্য: বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকদের জন্য উত্তরাধিকার আইন সমানভাবে প্রযোজ্য—গ্রাম হোক বা শহর।

মিথ ৯: সম্পত্তি ভাগ না করে একসাথে ব্যবহার করলেই ইসলামী আইন মানা হয়।
সত্য: ভাগ না করলে তা অস্থায়ী ব্যবহার হতে পারে, কিন্তু শরয়ী বণ্টন না করা পর্যন্ত প্রত্যেকে তার প্রাপ্য অংশ আইনত মালিকানা পায় না।

মিথ ১০: উইল (ওসিয়ত) করে পুরো সম্পত্তি এক ব্যক্তিকে দেওয়া যায়।
সত্য: ইসলাম কেবল ১/৩ অংশ পর্যন্ত উইল করার অনুমতি দিয়েছে। তাও বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্য নয়, বরং বাইরের মানুষ বা কল্যাণমূলক কাজে।

আরো পড়ুন: শুধু Website Visit করেই ঘরে বসে আয় করুন Sprout Gigs থেকে — কোনো ইনভেস্টমেন্ট লাগবে না

❓বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

১. ছেলে না থাকলে বাবার সম্পত্তি কীভাবে বণ্টিত হবে?

ছেলে না থাকলে মেয়েরা তাদের নির্ধারিত অংশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, এক মেয়ে থাকলে সে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে, আর দুই বা ততোধিক মেয়ে থাকলে তারা একত্রে সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ অংশের মালিক হবে। বাকি অংশ আসে আসাবাদের মাধ্যমে, যেমন মৃত ব্যক্তির ভাই বা চাচা। স্ত্রী ও পিতা-মাতাও তাদের নির্ধারিত অংশ পাবেন।

২. স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী কতটুকু সম্পত্তি পায়?

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর অধিকার নির্ভর করে সন্তান থাকার ওপর। যদি সন্তান থাকে, স্ত্রী সম্পত্তির এক অষ্টমাংশ পাবেন। সন্তান না থাকলে স্ত্রী সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ পাবেন।

৩. মা মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি কারা পাবে?

মায়ের সম্পত্তি তার বৈধ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হয়। স্বামী, ছেলে-মেয়ে এবং জীবিত পিতা-মাতা এখানে অংশীদার হতে পারেন। প্রতিটি উত্তরাধিকারীর অংশ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নির্ধারিত।

৪. মৃত চাচার সম্পত্তিতে ভাতিজার কি অধিকার আছে?

ভাতিজা তখনই চাচার সম্পত্তিতে অংশীদার হতে পারেন যখন চাচার কোনো ছেলে না থাকে। যদি চাচার ছেলে থাকে, তবে ভাতিজা কোনো অংশ পান না। এটি শরীয়াহর সুনির্দিষ্ট নিয়ম।

৫. বাবার মৃত্যুর পর আইনগত উত্তরাধিকারী কারা?

আইন অনুসারে প্রথম শ্রেণির উত্তরাধিকারী হলেন স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, পিতা এবং মাতা। তাদের অংশ কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী নির্ধারিত এবং এটি পরিবর্তন করা যায় না।

৬. মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ে কতটুকু পায়?

মেয়ের অংশ বাবার সম্পত্তির মতোই নির্ধারিত। এক মেয়ে থাকলে সে অর্ধেক অংশ পায়, আর একাধিক মেয়ে থাকলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ অংশের মালিক হয়। যদি ছেলে-মেয়ে উভয় থাকে, তবে মেয়ের অংশ ছেলের অর্ধেক হবে।

৭. বাবা জীবিত অবস্থায় মৌখিকভাবে যদি কাউকে জমি দিয়ে যান, তা কি বৈধ?

মৌখিক প্রতিশ্রুতি আইনগতভাবে কার্যকর নয়। জমি-সম্পত্তি হস্তান্তর বৈধ হতে হলে লিখিত দলিল তৈরি করতে হবে এবং রেজিস্ট্রি করতে হবে।

৮. ইসলামী উত্তরাধিকার আইন কি কেবল মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য?

হ্যাঁ। বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য। অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন বা 1925 সালের Indian Succession Act প্রযোজ্য।

৯. উইল (ওসিয়ত) করে কি পুরো সম্পত্তি এক সন্তানের নামে দেওয়া যায়?

না। ইসলামে জীবিত অবস্থায় সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ওসিয়ত করার অনুমতি আছে। বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্য ওসিয়ত করা যায় না, যদি না অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা সম্মত হন।

১০. সম্পত্তি ভাগ না করলে কী হয়?

বণ্টন না করলে উত্তরাধিকারীরা আইনি মালিকানা পাবেন না। তারা শুধু ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু শরিয়াহ অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য অংশের মালিকানা হবে না।

শেষ কথা ও বিশেষ পরামর্শ

বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি শুধু ইট-পাথর বা টাকার থলি নয়, এটি একটি পবিত্র আমানত। এই আমানত সঠিকভাবে বণ্টন করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। সামান্য কিছু সম্পদের লোভে আপন ভাই-বোনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা, মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করা—এসব ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

  • সম্পত্তি নিয়ে কোনো জটিলতা দেখা দিলে অবিলম্বে একজন বিশ্বস্ত ইসলামিক স্কলার এবং একজন অনভিজ্ঞ আইনজীবী-এর দ্বৈত পরামর্শ নিন।
  • সম্পত্তি নিয়ে কোন ঝামেলা এড়াতে সম্ভব হলে বাবা জীবিত থাকতেই সকলের অংশ স্পষ্ট করে একটি লিখিত arrangement বা ওসিয়ত করে রাখুন।
এই গাইডটি আপনার জন্য কতটা উপকারী ছিল? আপনার মনে এখনও যদি "বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম" নিয়ে কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। আমাদের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নিন সঠিক উত্তর। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি Facebook, WhatsApp-এ আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন, যাতে তারাও তাদের ইসলামী ও আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। শেয়ার করে অন্যকে সচেতন করার এই কাজটি সাদাকায়ে জারিয়ার মতো।

Juger Alo Google Newsযুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News নিউজ অনুসরণ করুন

4 thoughts on “ইসলামে বাবার সম্পত্তি ভাগের নিয়ম | বন্টন আইন বাংলাদেশ ২০২৫”

Leave a Comment