ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার ধাক্কা: সয়াবিন ও পাম তেলের বাজারে অস্থিরতা

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বাজারে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষরা চাপের মধ্যে পড়েছেন। বোতলজাত সয়াবিন তেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বোতলের সরবরাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি খোলা তেলের বৃদ্ধি পাওয়া দাম ইঙ্গিত করছে বাজারে আরও বড় ধরণের মূল্যবৃদ্ধির।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

আরও পড়ুন: বাজার থেকে উধাও হচ্ছে সয়াবিন তেল: দাম আরও বাড়ার শঙ্কা

খোলা তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ

গত এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ২০ টাকার মতো বেড়ে গেছে। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ১৭২ টাকা এবং পাম তেলের লিটার ১৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দর বৃদ্ধির ফলে বাজারে এক অস্বাভাবিক চিত্র তৈরি হয়েছে, যেখানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তবে কিছু দোকানে এই মূল্য ১৭০ টাকায়ও পৌঁছেছে।

বোতলজাত তেলের সরবরাহ সংকট

বিক্রেতারা বলছেন, খোলা তেলের দাম বাড়ার কারণে বোতলজাত তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে অনেক কোম্পানি। তারা ধারণা করছেন, এটি একটি মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার এক দোকানি হারুনূর রশিদ জানান, তিনি বোতলজাত তীর কোম্পানির সয়াবিন তেল ১৭০ টাকায় বিক্রি করছেন, যদিও বোতলে গায়ের দাম ১৬৭ টাকা লেখা রয়েছে। তিনি জানান, তার কেনা পড়েছে ১৬৪ টাকা, তাই কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো তেলের সংকটের কথা বলে আগের মতো সরবরাহ করতে পারছে না।

পাম তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব

বিশ্ববাজারে পাম তেলের সরবরাহে সংকট তৈরি হওয়ায় এর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সয়াবিন তেলের বাজারেও। মালয়েশিয়ায় পাম তেলের মজুদ কমে যাওয়ার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এর দাম বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে পাম তেল আমদানিতে জটিলতা তৈরি হওয়ায়, এর দাম আরও বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম বাড়ায় আমদানিকারকদের কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: বাজারে চালের চেয়ে আলুর দাম বেশি, চাপে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা

ভোজ্যতেলের দাম
ভোজ্যতেলের দাম

ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা এবং ব্যবসায়ীদের বক্তব্য

বাংলাদেশ গ্রোসারি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন খান জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম ওয়েলের দাম বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নানা অস্থিরতা এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে। তিনি আরও বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল পর্যাপ্ত পরিমাণে সংরক্ষিত থাকায় এর দামে এখনও তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে খোলা তেল ও পাম তেলের বাজারে অস্থিরতা থাকায় এর দাম বাড়তে থাকছে।

সরকারের পদক্ষেপ

ভোজ্যতেলের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৭ অক্টোবর, পাম ও সয়াবিন তেলের উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে সয়াবিন ও পাম তেলের উপর মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার ভোক্তাদের ওপর চাপ কমাতে চেষ্টা করছে, তবে বাজারে এর বাস্তব ফলাফল এখনও পুরোপুরি দেখা যায়নি।

পাইকারি বাজারের অবস্থা

কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের পাইকারি দোকানগুলোতেও তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এক বিক্রেতা জানালেন, ১০ দিন আগেও তিনি পাম তেল ১৫২ টাকা লিটারে কিনতেন, কিন্তু এখন তা ১৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে তেলের সংকটের কারণে অনেক দোকানদার তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

অন্যদিকে, বোতলজাত তেলের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন বোতলের তেল ড্রামে ঢেলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করছেন। এভাবে বিক্রি করলে তাদের লাভ বেশি হয় এবং তারা দামও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারেন।

আরও পড়ুন: ডালের বাজারে নৈরাজ্য চরমে, কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে। রান্নার তেল হিসেবে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলই বেশি ব্যবহৃত হয়, তাই এই দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে।

ডিম, সবজি, পেঁয়াজ এবং চালের দাম বৃদ্ধির পর এখন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় ভোক্তাদের সামগ্রিক ব্যয় আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ যারা প্রতিদিনের খাবারের জন্য এসব পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ভোজ্যতেলের দাম
ভোজ্যতেলের দাম

ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের সংকট অব্যাহত থাকে এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতেও ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া, বোতলজাত তেলের সরবরাহ যদি আরও কমে যায়, তবে এর দামও বেড়ে যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন, আগামী মাসগুলোতে তেলের মূল্য আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন: এসএমএসে দাম চালাচালি করতে পারছে না কোম্পানিগুলো, ডিমের বাজারে স্বস্তি

সমাধানের পথ

বাজারের এই অস্থিরতা মোকাবেলায় সরকারের উচিত আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি রোধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব না হলেও, দেশীয় বাজারে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত এবং ব্যবসায়ীদের মুনাফার সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। ভোক্তাদের জন্য টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়া তেল সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে, যা বাজারের তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।

উপসংহার

বর্তমান ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ ভোক্তারা বাড়তি চাপের মুখে পড়ছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। তবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

Juger Alo Google News যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

Leave a Comment