রাজনীতি আর আন্দোলনের ভেতরকার দ্বন্দ্ব সবসময়ই থেকেছে। কখনো তা চাপা পড়ে থাকে, আবার কখনো তা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে – ঠিক যেমনটা ঘটেছে বরিশালে। যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয় এক নাটকীয় সন্ধ্যায়। মুখ্য চরিত্রে ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নিজের রাজনৈতিক সফরের অংশ হিসেবে বরিশালে এসে তিনি পড়েন অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনার মধ্যে—অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বরিশাল ক্লাব মিলনায়তনে, পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয় তাকে বের করে আনতে।
ঘটনার পেছনের গল্পটা কেবল উত্তেজনার নয়, এটি বাস্তবতার, তৃণমূল কর্মীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের, নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার এবং সর্বোপরি একটি আন্দোলনের ভেতরকার টানাপড়েনের বহিঃপ্রকাশ।
যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
পটুয়াখালী থেকে বরিশাল: একটি রাজনৈতিক সফরের যাত্রা
ঘটনার শুরু হয় পটুয়াখালী থেকে। সেখানে গিয়েছিলেন নাহিদ ইসলাম, একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার খোঁজ নিতে। জুলাই আন্দোলনে নিহত এক ছাত্র নেতার কলেজপড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। নাহিদ সেখানে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন। এটি ছিল একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে মানবিক সহানুভূতির প্রকাশ।
সেখান থেকে ফিরে বরিশালে ক্লাব মিলনায়তনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এরপর আয়োজন করা হয় এক মতবিনিময় সভার—যেখানে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তবে এই সভাটিই পরিণত হয় উত্তপ্ত এক অস্থির মঞ্চে।
ভেতরকার ক্ষোভের বিস্ফোরণ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বরিশাল জেলা ও মহানগর কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমছিল সাধারণ কর্মীদের মাঝে। তাদের অভিযোগ ছিল—নেতৃত্ব স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংগঠন চালাচ্ছে, সাধারণ সদস্যদের মতামত শোনা হচ্ছে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কেবল হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জারে।
সভা শুরুর কিছু সময় পরই কর্মীদের একাংশ সভাকক্ষে প্রবেশ করে। তারা দাবি তোলে, আলাদাভাবে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং তাদের বক্তব্য রাখতে চান। কিন্তু নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এ দাবি মানা হয়নি। উপস্থিত নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও মুহূর্তেই শুরু হয় তর্কাতর্কি, তারপর ধাক্কাধাকি ও হাতাহাতি।
অবরুদ্ধ অবস্থায় একজন জাতীয় নেতার অসহায়তা
পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন নাহিদ ইসলাম সভাস্থল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বরিশাল ক্লাবের মূল ফটক আটকে দিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকর্মীরা। ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় মিলনায়তনের আশপাশ।
তাদের দাবির ছিল, নাহিদ ইসলাম যেন অন্তত ৫ মিনিট সময় দিয়ে কর্মীদের বক্তব্য শোনেন। তারা অভিযোগ করেন, সাত মাস হয়ে গেলেও বরিশালের সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে কোনো সরাসরি আলোচনায় বসেননি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা। শুধু আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবদের সঙ্গে অনলাইন ভিত্তিক যোগাযোগেই সীমাবদ্ধ থেকেছে দলীয় কার্যক্রম।
আরও পড়ুন
আরো পড়ুন: ফেসবুক স্টোরি থেকে আয়ের সুযোগ: কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য সুখবর, পারবনে আপনিও
পুলিশের হস্তক্ষেপ ও নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া
অবস্থার অবনতি দেখে বরিশালের কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। ওসি মিজানুর রহমান জানান,
“আমাদের টহল টিম বরিশাল ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় ছিল। হট্টগোল শুনে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাবের মূল ফটক বন্ধ করে রেখেছেন কিছু নেতাকর্মী। পরে পুলিশ গিয়ে গেট খুলে দিলে নাহিদ ইসলামকে বহনকারী গাড়িসহ মোট তিনটি গাড়ি নিরাপদে বেরিয়ে যায়।”
এই ঘটনায় কোনো বড় ধরনের সহিংসতা না ঘটলেও স্পষ্ট হয়েছে—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব সংকট।


দ্বিধা বিভক্ত নেতৃত্ব, ক্ষোভে ফেটে পড়া কর্মীরা
টিবিএস বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইফতারের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা ও মহানগর কমিটির সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কর্মীদের একটি অংশ মহানগরের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম শাহেদ এবং জেলা কমিটির সদস্য সচিব এস এম ওয়াহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলেন।
একজন বিক্ষুব্ধ কর্মী হৃদয় বলেন,
“বরিশাল জেলা ও মহানগর কমিটির নেতৃত্ব স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংগঠন চালাচ্ছে। আমরা আমাদের অভিযোগ দলীয় প্রধানের কাছে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাধা দেওয়া হয়। তাই আমরা গেট আটকে রাখি এবং দাবি জানাই যে নাহিদ ভাই আমাদের কথা শুনে তারপর চলে যাবেন।”
অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনের নেতা জোবায়ের কাইয়ূম বলেন,
“শহিদুল ভাই ও ওয়াহিদুর ভাই নিজেদের মতো করে সংগঠন চালান। আমরা যারা সাধারণ, তারা সবসময় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করি, অন্যায়ের আশ্রয় নেব না।”
নেতৃত্বের পাল্টা অভিযোগ: ষড়যন্ত্র চলছে!
অন্যদিকে বরিশাল মহানগর কমিটির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম শাহেদ এই ঘটনার জন্য দায়ী করেন কিছু ‘অনুপ্রবেশকারীকে’। তিনি বলেন,
“ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্টের দোসররা আমাদের কর্মসূচিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আজকের এই ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিকল্পনা করেই তারা অনুষ্ঠান বানচালের জন্য এসেছিল।”
নাহিদ ইসলাম ও এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারাও এই ঘটনার পর কোনো অবস্থান স্পষ্ট করেননি।


ঘটনার পেছনে বার্তা: নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে ব্যবধান
এই ঘটনাটি শুধুমাত্র একদিনের উত্তেজনার বিষয় নয়। এটি একটি গভীর সংকেত বহন করে—নেতৃত্ব ও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে যখন দূরত্ব বাড়ে, মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়, তখন সংগঠনের ভিতরে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ ও অবিশ্বাস।
তৃণমূল কর্মীরা শুধু অংশগ্রহণের সুযোগই চান না, তারা স্বীকৃতি চান, দায়িত্ব চান, এবং সবচেয়ে বড় কথা—শুনতে চান তাদের কথা। ৫ মিনিটের জন্য একজন নেতার সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে যে ক্ষোভ জন্ম নেয়, তা যেমন বাস্তব, তেমনি তা বিস্ফোরিত হলে পরিস্থিতি এমনই হয়।
শেষ কথা: সংগঠন বড়, নেতৃত্ব নয়
নাহিদ ইসলাম বরিশালে অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ভিত্তি হলো কর্মীদের সম্মান ও অংশগ্রহণ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এনসিপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন, স্বচ্ছ নেতৃত্ব এবং কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ওপর।
নেতাদের উচিত হবে শুধুমাত্র বক্তব্য দেওয়া নয়, বরং কর্মীদের অনুভব করা, তাদের কথা শোনা, এবং সেই অনুযায়ী দায়িত্বশীল ও অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা।