ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব কতটা মুখে আর কতটা কাজে!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বন্ধু। অন্যদিকে, মোদিও ট্রাম্পকে তার বন্ধু বলে দাবি করেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন মোদি কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, তখন ট্রাম্প জানিয়েছিলেন যে তিনি মোদির সঙ্গে দেখা করবেন। তবে মোদি সেই সময় ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই ভারতে ফিরে আসেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও ট্রাম্প বেশ কয়েকবার মোদির নাম নিয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিলেন। এখন দেখা যাক ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব কতটা মুখে আর কতটা কাজে!

আরও পড়ুন: ‘মিনিস্ট্রি অব সেক্স’ চালু করতে চায় রাশিয়া, কিন্তু কেন?

নির্বাচনের ফলাফলে যখন ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত ছিল, তখন মোদি তাকে একজন বন্ধু হিসেবে অভিনন্দন জানান। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, হিউস্টনে হাউডি মোদি অনুষ্ঠানে, ট্রাম্প এবং মোদি একত্রে প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকের সামনে ভাষণ দেন। সেখানে মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’’। পরবর্তীতে ২০২০ সালে, গুজরাটের আহমেদাবাদে ‘‘নমস্তে ট্রাম্প’’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন, যা তাদের বন্ধুত্বের এক নতুন চিত্র তুলে ধরে।

তবে, ট্রাম্প এবং মোদির বন্ধুত্ব শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই পারস্পরিক স্বার্থের উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প যদিও মোদিকে বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন, তবুও তিনি ভারতের বিভিন্ন নীতির প্রতি কঠোর সমালোচনাও করেছেন।

ট্রাম্পের সমালোচনা

এমনকি ট্রাম্পের ‘‘আমেরিকা ফার্স্ট’’ নীতি, যেটি তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, মোদির সাথে তার বন্ধুত্বের একটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। এই নীতির অধীনে, ভারত থেকে আমেরিকায় পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করা হতে পারে, বিশেষত প্রযুক্তি, ওষুধ, এবং পোশাকের ক্ষেত্রে। ট্রাম্প ভারতকে ‘‘শুল্কের রাজা’’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তিনি চান যে, ভারত তার পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করে, আমেরিকাও একই শুল্ক আরোপ করবে।

আরও পড়ুন: মাদরাসাবিরোধী আইন বাতিল করলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব এই সম্পর্কের মধ্যে একাধিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, যেমন ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ এবং অন্যদিকে আমেরিকা থেকে ভারতীয় বাজারে আমদানির বিষয়ে শুল্কের শিথিলতা চাওয়া। এছাড়া, ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ভারত বরাবরই আমেরিকা থেকে বেশি পণ্য রপ্তানি করে, এবং আমেরিকা ভারতে কম পণ্য রপ্তানি করে, যার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। ২০২২ সালে ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৯ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ছিল, তবে ট্রাম্প যদি তার শুল্ক নীতি কার্যকর করেন, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।

নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক স্টাইল

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব কানওয়াল সিবাল ট্রাম্প এবং মোদির সম্পর্ক সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘বন্ধুত্বের প্রকৃতি অনেকটা পারস্পরিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যখন স্বার্থের সংঘাত ঘটবে, তখন বন্ধুত্বের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পাবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এটা সত্য, আমেরিকা তখনই মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলে যখন তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।’’

আরও পড়ুন: ইরাক ইরান যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি? মহাযুদ্ধের হুমকির মুখে ইরান ও ইসরায়েল

মোদির রাজনৈতিক স্টাইল অনেকটাই কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। মোদি প্রায়শই ব্যক্তিগতভাবে নেতাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন এবং কখনও কখনও এটি কার্যকরী হয়। তবে ট্রাম্পের পক্ষে, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি নিজের স্বার্থের জন্য কোনও ছাড় দিতে রাজি নন।

রাশিয়া এবং চীন: কূটনৈতিক সংকট

মার্কিন নীতির কারণে রাশিয়া ও চীন আরও কাছাকাছি চলে যাচ্ছে, তবে ট্রাম্প প্রশাসন এখনও চীনের দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বিশেষত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে, আমেরিকার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। একদিকে ভারত রাশিয়া থেকে অস্ত্র সরবরাহ করে, অন্যদিকে চীন তাদের আঞ্চলিক প্রবণতায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

আরও পড়ুন: পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

ব্রহ্মা চেলানি, ইংরেজি পত্রিকা ‘ওপেন’-এ লিখেছেন, ‘‘পশ্চিমা স্বার্থ এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার প্রতি আসল হুমকি রাশিয়া নয়, বরং চীন।’’ তার মতে, রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়, তবে চীনের উদ্দেশ্য হলো আমেরিকার স্থান দখল করা।

ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব

কাশ্মির নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য

২০১৯ সালে, তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন, তখন ট্রাম্প কাশ্মির নিয়ে মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মোদি চেয়েছেন যে আমি কাশ্মির নিয়ে মধ্যস্থতা করি।’’, যা ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ভারত তখন ট্রাম্পের এই মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল যে, মোদি এমন কোনও কথা বলেননি। ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল যে, কাশ্মির নিয়ে তারা কোনো মধ্যস্থতা গ্রহণ করবে না।

ট্রাম্পের ‘স্বার্থ’ এবং ‘বন্ধুত্ব’

হর্ষ পান্ত, লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বলেছেন, ‘‘বন্ধুত্বের অর্থ এটা নয় যে আপনি সব বিষয় নিয়ে আপস করবেন।’’ তার মতে, ট্রাম্পের জন্য নরেন্দ্র মোদি একজন প্রিয় নেতা হলেও, ট্রাম্প কখনোই ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেবেন না।

পরিশেষে, ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব কেবলই রাজনৈতিক স্বার্থে নিবদ্ধ। তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি ঠিক কতটুকু হবে এবং কিভাবে বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, তা সময়ের উপর নির্ভর করবে। যেমন, যখন ভারত এবং আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্ক বা প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবে, তখন ট্রাম্পের ‘‘আমেরিকা ফার্স্ট’’ নীতি ভারতে কিছু কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

Juger Alo Google News   যুগের আলো’র সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

2 thoughts on “ট্রাম্পে মোদির বন্ধুত্ব কতটা মুখে আর কতটা কাজে!”

Leave a Comment