আজকাল আমাদের জীবনে মোবাইল ফোন এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, যেন কোনো মুহূর্তে আমরা এটি ছাড়া একটি দিনও কাটাতে পারি না। প্রতিদিনের কাজকর্ম, যোগাযোগ, বিনোদন—সবকিছুই যেন মোবাইলের মধ্যে আবদ্ধ। এই মোবাইল নির্ভর জীবনে এমন কিছু অভ্যাস গড়ে উঠেছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো খাবার খেতে খেতে মোবাইলে কথা বলা । যদিও এটি এখন খুব সাধারণ একটি দৃশ্য, তবে কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি যে, এই অভ্যাসটি আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতার জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে?
আরও পড়ুন: স্মার্টফোনের ব্রাইটনেস কতটুকু রাখা জরুরি? ৯৯% মানুষ জানেন না
মোবাইল ফোনের সাথে আমাদের সম্পর্ক এত গভীর যে, খাবারের সময়ও এটি আমাদের হাত থেকে ছাড়ে না। অনেকেই খাবারের টেবিলে বসে মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুঁ মারেন, কেউ অফিসের কাজ সেরে ফেলেন, আবার কেউ টেলিফোনে কথা বলতে থাকেন। এমনকি শিশুকে খাওয়ানোর সময়ও অনেক মা-বাবা মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে এই দৃশ্য আরও বেশি পরিলক্ষিত হয়—খাবার প্লেটের সামনে ফোন হাতে সবাই ব্যস্ত থাকে। তবে একবার কি ভেবে দেখেছেন, এই মুহূর্তে মোবাইলে কথা বলা আমাদের শরীরের জন্য কী পরিমাণ ক্ষতিকর?
আরও পড়ুন: ফেসবুক কীভাবে আপনাকে অসুখী মানুষে পরিণত করছে, আপনি জানেন?
মোবাইলে কথা বলার কারণে খাবারের অভ্যাসে পরিবর্তন
মোবাইলে কথা বলার সময় আমাদের মনোযোগ পুরোপুরি খাবারে থাকে না। এর ফলে অনেক সময় খাবারের পরিমাণে ভুল হয়ে যায়। যেমন, অনেকেই খেতে খেতে মোবাইলে কথা বলার কারণে বেশি খেয়ে ফেলেন, আবার কেউ আবার পুরোপুরি খেয়েই উঠতে পারেন না। যখন খাবারের প্রতি মনোযোগ কমে যায়, তখন পুষ্টির মাত্রাও ব্যাহত হয়। এর ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ ঠিকমতো পৌঁছায় না এবং শরীর দুর্বল হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের সময় মোবাইল ব্যবহার করার কারণে মস্তিষ্কে যে হরমোনের কার্যকলাপ ঘটে, তা বিঘ্নিত হয়। সাধারণত, খাবার খাওয়ার সময় মস্তিষ্কে হরমোন নিঃসৃত হয়, যা হজম ও বিপাক প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে। কিন্তু যখন আমরা মোবাইল ফোনে কথা বলি বা মেসেজ পাঠাই, তখন এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলস্বরূপ, খাবারের হজমে গণ্ডগোল হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
চোকিংয়ের ঝুঁকি
খাবারের সময় মোবাইলে কথা বলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিপদ হলো চোকিং। আমাদের খাদ্যনালি ও শ্বাসনালি একে অপরের কাছে অবস্থিত। মোবাইলে কথা বলতে গেলে, আমরা খাবার গিলতে ভুলে যেতে পারি বা ভুলভাবে খাবারটি গিলে ফেলতে পারি, যা শ্বাসনালিতে আটকে যেতে পারে। এতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয় এবং চোকিংয়ের ফলে মৃত্যুঝুঁকিও থাকে। এটি এমন একটি সমস্যা যা অনেকেই খেয়াল করেন না, তবে এটি জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলতে পারে।
আরও পড়ুন: অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ও নিবন্ধন করার সহজ উপায়
মাইন্ডফুল ইটিং: খাবারের প্রতি মনোযোগ দেওয়া
বর্তমানে “মাইন্ডফুল ইটিং” বা “মনোযোগীভাবে খাওয়া” একটি জনপ্রিয় ধারণা হয়ে উঠেছে। এর মানে হলো খাবার খাওয়ার সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খাবারের স্বাদ, গন্ধ, রং এবং অনুভূতি উপভোগ করা। যদি আমরা মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকি, তবে এই মনোযোগী খাবারের অভ্যাসটি ভেঙে যায়। ফলে, আমরা খাবারের পূর্ণ পুষ্টিমান থেকে বঞ্চিত হতে পারি। বিশেষ করে শিশুদের খাওয়ানোর সময় এটি আরও বেশি গুরুত্ব বহন করে। শিশুরা যদি খাবারের প্রতি মনোযোগ না দেয়, তবে তারা খাবারের গন্ধ, রং বা স্বাদ পুরোপুরি অনুভব করতে পারে না। ফলে তাদের শরীরের পুষ্টি প্রাপ্তির সম্ভাবনা কমে যায়।
আরও পড়ুন: ফোনের স্টোরেজ খালি করার ১০টি সহজ ও কার্যকর উপায়
মোবাইলে কথা বলার ফলে পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি
খাবারের সময় ফোন ব্যবহার শুধুমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটি পারিবারিক সম্পর্কের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন আমরা পরিবারের সদস্যদের সাথে একসাথে বসে খাবার খাই, তখন এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, যা আমাদের একে অপরের সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। তবে মোবাইলে কথা বলার কারণে আমরা আমাদের পারস্পরিক সময় নষ্ট করে ফেলি। বিশেষ করে, যখন আমরা বন্ধু বা পরিবারের সাথে খাবার খাচ্ছি, তখন ফোনে সময় দেওয়া একেবারেই অনুচিত। এই সময়টুকু আমাদের নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করার, একে অপরের সাথে সময় কাটানোর এবং একে অপরের কথা শোনার জন্য হওয়া উচিত। ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, আমরা এমন একটি মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলি, যা পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন: বিনামূল্যে আইটি প্রশিক্ষণ, থাকছে কর্মসংস্থানের সুযোগ
মোবাইলে কথা বলা এবং শিশুর আচরণগত সমস্যা
বাচ্চাদের জন্য খাওয়ার সময় মোবাইল ব্যবহার আরো বেশি বিপদজনক। আজকাল অনেক মা-বাবা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকার সময় তাদের শিশুকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে শিশুর মধ্যে খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায় এবং তারা খাবারের স্বাদ ও উপকারিতা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। এতে শিশুর পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে, যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। শিশুদের খাবার খাওয়ার অভ্যাস সঠিকভাবে গড়ে ওঠা খুবই জরুরি, কারণ এটি তাদের ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যের জন্য প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। মোবাইলের মাধ্যমে শিশুর মনোযোগ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে, তা তাদের শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
খাবার ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা
সাধারণত, খাবার খাওয়ার সময় আমাদের পুরো মনোযোগ খাওয়ার প্রতি দেওয়া উচিত, তবে মোবাইলে কথা বলার কারণে এটি ব্যাহত হয়। যখন আমরা খাওয়ার সময় অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করি, তখন খাবার হজম হতে সময় নেয় এবং এর পুষ্টিগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আমাদের উচিত খাবারের সময় মোবাইল ফোনটি দূরে রেখে, খাবারের স্বাদ ও গন্ধে পুরো মনোযোগী হওয়া।
উপসংহার
এখনকার যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তবে খাবারের সময় মোবাইলে কথা বলা বা মোবাইল ব্যবহার করার অভ্যাস আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এটি শুধুমাত্র আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং পারিবারিক সম্পর্ক ও শিশুর আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, খাবারের সময় মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত এবং পরিবার, বন্ধু বা স্বজনদের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করা উচিত। এই অভ্যাসগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পুষ্টি ও সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সহায়তা করবে।